বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই
১৫ জানুয়ারি ২০১৭নির্যাতিত গৃহবধু ববিতা ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘২০১৫ সালের ৩০শে মার্চ আমার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাদের লোহাগড়ার কাশিপুর ইউনিয়নের এড়েন্ডা গ্রামের বাড়িতে আমাকে গাছের সঙ্গে বেধে নির্যাতন চালায়৷ এ ঘটনার পর আমি থানায় মামলা করতে গেলে লোহাগড়া থানা মামলা নেয়নি৷ তবে তার মধ্যে সেই নির্যাতনের ছবি প্রকাশ হয় পত্র-পত্রিকায়৷ এরপর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ হাইকোর্টে রিট করেন৷ তখন হাইকোর্ট জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়৷ একইসঙ্গে আমার চিকিৎসারও নির্দেশ দেয় হয়৷''
ববিতা জানান, ‘‘পাঁচদিন পর, অর্থাৎ ৫ই মে পুলিশ মামলা নেয় এবং আমার স্বামীসহ আটজনকে আটক করে৷ আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় এবং আমাদের আবসস্থল একই উপজেলার শালবরাত গ্রামে আমার বাবার বাড়িতে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়৷''
এরপর ‘‘আসামিরা আটক হওয়ার তিন-চার মাস পর জামিন পেয়ে যায় এবং আদালতে এখনও মামলাটির বিচার চলছে'', জানান ববিতা৷
সুপ্রিমকোর্টে সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আর কেউই নন৷ তিনি হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ বা এইচআরপিবি-এর প্রেসিডেন্ট৷ এই সংগঠনের পক্ষ থেকেই তিনি রিট আবেদনটি করেছিলেন৷ মনজিল মোরসেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার, সাংবিধানিক অধিকার এবং আইনগত অধিকারের পক্ষে কাজ করছি৷ যেখানেই এটা লঙ্ঘিত হয় সেখানেই আমরা আইনগত লড়াই চালাই৷''
তাঁর কথায়, ‘‘এর মধ্য দিয়ে দেশের নাগরিকরা যেমন উপকৃত হন, তেমনি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অনেক আদেশ ও নির্দেশনাও পাওয়া যায়, যা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্য অনুকরণীয়৷''
সর্বশেষ চিকিৎকদের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশনের ব্যাপারে একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত৷ তাতে হাইকোর্ট স্পষ্ট অক্ষরে এবং বড় হরফে পড়ার উপযোগী করে চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনে লেখার নির্দেশনা দিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সার্কুলার জারি করার নির্দেশ দিয়েছে৷ কারণ অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশনও রোগিদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে৷ অ্যামেরিকার ইনস্টিটিউট অফ মেডিসিন বা আইওএম-এর এক প্রতিবেদন বলছে, প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসকদের হাতের লেখা বুঝতে না পারার কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৭ হাজার রোগীর মৃত্যু হয়৷
মনজিল মোরশদে জানান, ‘‘আমরা এই প্রেসক্রিপশন নিয়ে রিট করা ছাড়াও নিম্নমানের ওষুধ, ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক এবং ৩৪টি কোম্পানির বিভিন্ন ক্ষতিকর ওষুধ নিয়ে হাইকোর্টে রিট করে ফল পেয়েছি৷ এরফলে জনস্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে৷''
এইচআরপিবি এ পর্যন্ত ২৮০টি জনস্বার্থ মামলা বা রিট করেছে উচ্চ আদালতে৷ এরমধ্যে ৪৮টি মামলায় রায় পাওয়া গেছে৷ জনস্বার্থে এইসব মামলার মধ্যে আইনগত অধিকার, নদী ও পরিবেশ রক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্যাতন, বিচার না পওয়া, অবৈধ আদেশ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ঐতিহাসিক স্থান এবং স্থাপনা রক্ষা প্রভৃতি বিষয় রয়েছে৷''
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘আমরা সংবিধানের ষোড়শ সংশোনী নিয়ে রিট করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় যেমন কাজ করেছি, তেমনি লালবাগ কেল্লার স্থাপনা ভাঙার বিরুদ্ধে রিট করেও ফল পেয়েছি৷ এছাড়া সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ও ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের স্থান সংরক্ষণের জন্য রিট করে আমাদের পক্ষে আদেশ পেয়েছি৷''
মনজিল মোরসেদের এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য হলো সার্বিকভাবে মানবাধিকার, সাংবিধানিক অধিকার এবং আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা৷ তবে এতে সরাসরি অনেক ব্যক্তি এবং পেশাজীবীরা উপকৃত হয়েছেন৷ খুলনার পাইকগাছার পাক্ষিক গণমিছিল পত্রিকার সম্পাদক এস এম এ রাজ্জাক এর একটি উদাহরণ৷ তিনি বারবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রোষানলে পড়ে নির্যাতন ও আটকের শিকার হন৷ এমনকি পুলিশের সহায়তায় তাঁকে হত্যা চেষ্টারও অভিযোগ আছে৷ রাজ্জাক ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘২০১১ সালে মনজিল মোরসেদ তাঁর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ-এর মাধ্যমে হাইকোর্টে রিট করলে আমার গ্রামের বাড়িতে পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হয়৷ এতে করে হয়রানি, আটক বন্ধ হয়৷''
নড়াইলের ববিতা বলেন, ‘‘মনজিল মোরসেদের রিটের পর আমি নিরপত্তা পেয়েছি, চিকিৎসা পেয়েছি, আসামিরাও আটক হয়েছে৷ তবে এখন আসামিরা আবারো হুমকি দিচ্ছে৷ আমার বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে৷ পুলিশি নিরাপত্তা হঠাৎ করেই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে৷ আমার মনে হয়, মনজিল মোরসেদ আবার বিষয়টি আদালতে তুললে আমি প্রতিকার পাবো৷''
এটা ধরেই মনজিল মোরসেদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আপনারা কি পরে আদালতের রায়ের ফলোআপ করেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘‘অবশ্যই করি৷ আদালতের আদেশ কার্যকর হলো কিনা, তা আমরা মনিটর করি৷ যদি না হয়, তাহলে আমরা আদালত অবমাননার মামলার মাধ্যমে রায় কার্যকরের পদক্ষেপ নিই৷''
মনজিল মোরসেদ আরো জানান, ‘‘আমরা চাই আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা৷ আইনজীবী হিসেবে তাই আমরা এই পথ বেছে নিয়েছি৷ এটা আমাদের একটা ‘কমিটমেন্ট'৷ আমরা চাই দেশের মানুষ যেন তাঁদের সব ধরনের অধিকার ভোগ করতে পারেন৷ তাঁদের কেনো অধিকারই যেন লঙ্ঘিত না হয়৷''
বন্ধু, মনজিল মোরসেদের এই উদ্যোগটি কি আপনি সমর্থন করেন? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷