মানবদেহে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব
২৫ এপ্রিল ২০১১চেরনোবিল এবং ফুকুশিমা দুর্ঘটনার দায়-দায়িত্ব এখনো কেউ নিচ্ছে না৷ চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর কত মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে তা নথিভুক্ত করা হয়নি৷ মানুষের জীবনের কোন মূল্যই কি তাহলে নেই?
ফুকুশিমার পারমাণবিক কেন্দ্রের প্রায় ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত কোন মানুষের জন্য নিরাপদ নয় – জানিয়েছে গ্রিনপিস৷ এই ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত দুটি গ্রাম পড়েছে৷ তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার হার সেখানে বেশ তীব্র৷ তা জানা সত্বেও কর্তৃপক্ষ সেখানে বসবাসরত মানুষদের সরিয়ে নেয়নি৷ জীববিজ্ঞানী কাটসুমি ফুরিটসু বললেন,‘‘এসব গ্রামের মানুষরা তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসার পরও তাদের সরিয়ে নেয়া হয়নি৷ এখন পর্যন্ত না৷ পরমাণু কেন্দ্রের ২০ কিলোমিটারের পরিধির মধ্যে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে মাত্র৷ এর পরেও যারা রয়েছে তাদের ঘরে থাকতে বলা হয়েছে৷ অথচ তা মোটেই নিরাপদ নয়৷''
কাটসুমি ফুরিটসু মানবদেহে তেজস্ক্রিয়তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন৷ তিনি সম্প্রতি বার্লিনে এসেছিলেন৷ হিরোশিমার বিভীষিকার শিকার যারা তাদের অসুখ-বিসুখ এবং পরবর্তী প্রজন্মের ওপর তার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন৷ চেরনোবিল দুর্ঘটনার পরও তিনি সেখানকার মানুষদের নিয়ে কাজ করেছেন৷ অ্যামেরিকান বেশ কিছু বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা জানিয়েছেন পরমাণু দুর্ঘটনার ঘটনাস্থলের ৮০ কিলোমিটার পরিধির মধ্য থেকে মানুষদের সরিয়ে নেয়া উচিত৷
দায়িত্ব নিতে রাজি নয় আইএইএ
স্বয়ং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএ নির্দিষ্ট করে কোন প্রতিকারের কথা বলেনি৷ সমালোচকরা বেশ জোর দিয়েই বলেছেন, চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর আইএইএ খোলসা করে কোন তথ্য জানায়নি৷ কখন কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে, এখন কী করা উচিত – এসব কোন প্রশ্নের উত্তর আইএইএ-র কাছ থেকে পাওয়া যায়নি৷ তেজস্ক্রিয়তা এবং তার প্রভাব নিয়ে বার্লিনে গবেষণা করছেন সেবাস্টিয়ান ফ্লুগবাইল৷ তিনি জানালেন,‘‘আইএইএ-র সূচীপত্রে বেশ পরিষ্কার করে বলা আছে, ইতিবাচক কাজের জন্য প্রয়োজনে পরমাণু কর্মকাণ্ড চালানো যাবে৷ শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য তা সিদ্ধ৷
তবে কখনো দুর্ঘটনা ঘটলে কী করা যেতে পারে, মানুষ শারীরিক কোনো ধরণের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলে তাদের কীভাবে সাহায্য করা যেতে পারে তা নিয়ে কিছু বলা নেই৷ খারাপ ধরণের দুর্ঘটনা ঘটলে তা আইএইএ পুরোপুরি চেপে যায়৷''
চেরনোবিল এবং ফুকুশিমার দুর্ঘটনার পর জাতিসংঘকে এ বছরের শুরুতে জানানো হয়েছিল, চেরনোবিল দুর্ঘটনার জন্য খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই৷ শারীরিকভাবে কোনো ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন সাধারণ মানুষরা হবে না৷ তবে যে সব চিকিৎসকরা এসব রোগীদের দেখাশোনা করছেন তাদের ভাষ্য পুরোপুরি ভিন্ন৷ তাদের অভিজ্ঞতা বলছে অন্য কথা৷ তারা প্রতিনিয়ত চেরনোবিলের শিকার যারা তাদের সেবা দিয়ে আসছেন, তাদের বিভিন্ন ধরণের অসুখ-বিসুখ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে গেছেন৷ আক্ষেপের সঙ্গে ফ্লুগবাইল জানালেন,‘‘যা ঘটেছে তা পুরোপুরি মানবসৃষ্ট৷ পরমাণু কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কাছে সাধারণ মানুষ খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের ওঠা-বসা৷ সেখানেই তাদের স্বার্থ৷ আর রাজনৈতিক দলের স্বার্থ মানে সেখানে দেশের স্বার্থ জড়িত৷ দেশও চায় যেভাবেই হোক পরমাণু কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে৷''
মিউনিখের হাইমহোল্স ইন্সটিটিউটের গবেষক হাগেন শ্যার্ব কিছুদিন আগে একটি জরিপে জানিয়েছেন অজানা কিছু তথ্য৷ সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন গোটা ইউরোপে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ইউরোপে ১০ লক্ষ কম শিশু জন্ম নিয়েছে৷ চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর যে তেজস্ক্রিয়তা গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল এটা তারই ফল৷
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কোন মাথাব্যথা নেই
এক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী করতে পারে? তাদের কী আদৌ কিছু করার আছে? চেরনোবিল দুর্ঘটনার সময় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় কাজ করতেন কিথ বেভারস্টক৷ তিনি জানালেন,‘‘আমি বিশ্বাস করি, সংস্থাটি এই সমস্যাকে চিহ্নিত করছে না৷ এছাড়া এই সমস্যাটি তাদের এক্তিয়ারে বলে তারা মনে করছে না৷ এবং পরমাণু কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত দুর্ঘটনা শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম বা মানুষের জন্য হুমকি বলেও তারা মনে করছে না৷ পরমাণু কেন্দ্র যেন কোনো কয়লাখনি বা তেলের রিগের সঙ্গে তুল্য৷''
তবে একটি দপ্তর খোলার কথা ভাবা হচ্ছে যেখানে এসব দুর্ঘটনার প্রতিকারে কী করা উচিত – শুধু তা নিয়ে গবেষণা এবং কাজ চলবে৷ মানব দেহকে সুস্থ রাখতে, মানবজাতিকে রক্ষা করতে গোটা ইউরোপ এক্ষেত্রে একমত হয়েছে৷ দপ্তরের নাম হবে ‘নিউক্লিয়ার এমার্জেন্সি প্রজেক্ট অফিস'৷
প্রতিবেদন: মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদনা: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী