মাদক : মস্তিষ্কের রাসায়নিক দানব
৪ জুন ২০২১১.বালাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে হ্যালুসিনোজেনস ( Hallucinogens) গোত্রভুক্ত মাদকের আগ্রাসন দেখে চমকে উঠেছি৷ এ গ্রুপের মাদক এলএসডি (Lsergic acid diethylamide) আসক্ত কতিপয় যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ ভিডিও ফুটেজে দেখেছি তাদের৷ গ্রেপ্তারের কারণে কোনো ভয় কিংবা প্রতিক্রিয়া তাদের অভিব্যক্তিতে দেখা যায়নি৷ হাসিখুশি এই তরুণদলটাকে দেখে শুধুমাত্র জাতি চমকে ওঠেনি,পুলিশদলও হতবাক হয়ে গেছে৷ গ্রেপ্তার হওয়ার পরও কেন আসক্ত তরুণেরা ছিল প্রতিক্রিয়াহীন, নির্বিকার, কিংবা হাসিমুখে? এ প্রশ্নের উত্তর জানার আগে জেনে নিতে হবে হ্যালোসিনোজেনস শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ৷
এটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Allucinan থেকে৷ এর অর্থ dream to wonder in mind. চারপাশ প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা, আবেগ-অনুভূতি এবং তার প্রকাশসহ অন্যান্য মানসিক প্রক্রিয়াগুলো বদলে দেয়, কিংবা বিকৃত করে দেয় এ মাদক৷ যথাযথ চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পায়, ভেতরের শক্তি কিংবা তাগিদ: উৎসাহ-আকাঙ্ক্ষা -চাহিদা সব কিছু দখলে নেয় মাদক৷
২. পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ব্রেন যেসব তথ্য গ্রহণ করে তা প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে আমাদের বোধ তৈরি করে, উপলব্ধি তৈরি করে ৷ এসব তথ্য যথাযথভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ আবেগ-অনুভূতির জন্ম দেয়৷ স্মরণশক্তি কিংবা কগনিটিভ প্রসেস বা অবহিতিকরণ প্রক্রিয়ায়ও তা ব্যবহার করে ব্রেন৷ যথাযথ চিন্তা করার ক্ষমতা ,যুক্তি আরোপের ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও কগনিটিভ প্রসেসের গুরুত্বপূর্ণ অনুষদ৷ মাদক তা বদলে দেয়, বিকৃত করে দেয়৷
মনের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি বদলে যাওয়া কিংবা বিকৃত হওয়ার কারণে অভিব্যক্তি কিংবা আচরণেও তার প্রভাব পড়ে- যা আমরা দেখেছি ওই তরুণদলের আচরণ এবং প্রকাশভঙ্গিতে৷
এ মাদক কেবলই স্বপ্নময় জগতে আসক্তজনকে ছুটিয়ে নিয়ে যায় না, হ্যালুসিনেশন-ডিলিউশন সৃষ্টি করতে পারে৷ দুঃস্বপ্নে ডুবিয়ে দিতে পারে তাদের৷
হ্যালুসিনেশন অর্থ চারপাশে কোনো ধরনের সেনসরি উদ্দীপক না-থাকার পরও তা তারা দেখতে পায়, শুনতে পায়, তার স্পর্শ পায়, গন্ধ পায়, কিংবা স্বাদ পায়৷ বাস্তবে হ্যালুসিনেট করে এমন ব্যক্তির সঙ্গে কেউ কথা না-বললেও আজগুবি কারো কথা সে শুনতে পারে ৷
আর ডিলিউশন (Delusion) অর্থ ভ্রান্ত-অলীক অবিশ্বাস্য কোনো ঘটনাও সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে পারে৷ কোনো যুক্তি দিয়ে সে-বিশ্বাস খন্ডানো যায় না, তার অবস্থান থেকে তাকে টলানো যায় না ৷ চারপাশ বা সমাজের অন্য কেউ তা বিশ্বাস করে না, সামাজিক প্রেক্ষাপট বা ধর্মীয় অনুশাসন দিয়েও তা মাপা যায় না৷ এভাবে আসক্তজন বদলে যায়৷ ব্রেইনের ভেতর থেকেই বদলে যায়৷ তার আবেগ ও মানবিক অনুভূতি যেমন শ্রদ্ধা-মায়া-মমতা-ভালোবাসা, বিশ্বাস-আস্থা সব ছারখার হয়ে যেতে থাকে৷ দিনে দিনে হিংস্র-নিষ্ঠুর-নির্মম-পাষণ্ড হয়ে ওঠে আসক্তজন৷ তাদের মস্তিষ্ক রাসায়নিক বোমায় পরিণত হয়৷ বোমা বিস্ফোরিত হলে যেমন চারপাশ লন্ডভন্ড হয়ে যায়. তেমনিভাবে তাদের হিংস্র আচরণ পুরো পরিবারকে তছনছ করে দেয়; প্রিয়জনের জীবন বিষিয়ে তোলে, নিঃশেষ করে দেয় পরিবার এবং স্বজনদের৷ জীবনের ট্রেক থেকে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে যায় আসক্তজান৷
৩. মাদককে 'না' বলতে হবে ৷
‘না' বলার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে ৷
‘না' বলার জন্য আত্মবিশ্বাসী হতে হবে ৷
‘না' বলার শক্তি অর্জন করতে হলে নিজের দক্ষতাকে শাণিত করতে হবে৷
‘না' বলতে হলে অশুভ সঙ্গী ও অশুভ পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে হবে৷
ভালো বন্ধু সার্কেল গড়ে তুলতে হবে৷
নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী ভালো ভালো কাজ করতে হবে; নিজের মেধা নিজের উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে৷ তাহলে সমাজের উন্নয়ন ঘটবে, দেশের উন্নয়ন ঘটবে৷
৪.পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে কাদামাটির বয়স থেকে শিশু লালন-পালনের সময় সন্তানের মনোজগতে এমন বৈশিষ্ট্যের বীজ রোপণ করতে হবে যেন সে বড় হয়ে আত্মবিশ্বাসী-আত্মপ্রত্যয়ী-আত্মমর্যাদাশীল হয়৷ বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে বাবা-মাকে৷
আর এ জীবনচর্চায় প্রধান রসায়ন হচ্ছে শিশুর বয়সের স্তরে নেমে শিশুকে বোঝা ৷ তার ভালো কাজের প্রশংসা করা ৷ তার সঙ্গে সৎ থাকা৷ আনন্দময় পরিবেশে খেলাধুলার নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা৷ তার নিরাপত্তাবোধ সুরক্ষা করা, ভুল কাজে তার উদ্দেশে শ্লেষাত্মক শব্দ ব্যবহার না-করা৷ উপযুক্ত সময়ে তা বুঝিয়ে বলা, সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া৷
ব্যতিক্রম থাকলেও বলা যায় আত্মবিশ্বাসী-আত্মপ্রত্যয়ী-আত্মমর্যাদাশীল সন্তানের পক্ষে মাদক থেকে দূরে থাকা সহজ হয়৷