সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিভৎসতা
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩৷ যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর যখন আনন্দের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে শাহবাগ, ঠিক তখনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা রাস্তায় নেমে পড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য৷
কিছু একটা হতে পারে তা আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল৷ কিন্তু এর মাত্রার ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা ছিল না কারো৷ সন্ধ্যা হতে না হতেই মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ত্রিশের ওপরে৷ রাত গড়িয়ে সকাল হতে হতে সেই সংখ্যা অতিক্রম করলো একশ৷ জামায়াত-শিবিরের ধরিয়ে দেয়া আগুনে জ্বলল বিভিন্ন এলাকার সরকারি অফিস-আদালত৷ কোনো কারণ ছাড়াই অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হলো অমুসলিম জনগোষ্ঠী৷ ভেঙে ফেলা হলো প্রতিমা, জ্বালিয়ে দেয়া হলো মন্দির৷ পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হলো মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের ওপর৷ উপড়ে ফেলা হলো রেললাইন, পুড়িয়ে দেয়া হলো বাস-ট্রাক, ককটেল ও বোমা হামলা চলতে থাকল যানবাহনের ওপর৷ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হলো যোগাযোগ ব্যবস্থাকে৷ সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ চালানো হয় পুলিশের ওপর, থানায়৷ অস্ত্র কেড়ে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় পুলিশকে৷
ঘটনার ভয়াবহতা দেখে হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কিছু করার তাগিদে আমরা ক'জন কিছু দিনের মধ্যেই রওনা হই চট্টগ্রামের বাঁশখালীর দিকে৷ পৌঁছে যে দৃশ্য দেখলাম তা ছিল করুণ, হৃদয়বিদারী, হতাশাজনক এবং ভীতিকর৷
বাঁশখালীতে আমরা পৌঁছেছিলাম ঘটনার ৯ দিন পরে৷ কিন্তু তখনো দেখে মনে হচ্ছিল যেন গতকালই হামলা করেছে জামায়াত-শিবির৷ সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে শিল পাড়ার মানুষগুলো৷ ঘর-বাড়ি, হাঁড়ি-পাতিল, কাপড়-চোপড়সহ সব কিছু জামায়াত-শিবির কর্মীদের ধরিয়ে দেয়া আগুনে পুড়ে ছাই৷ ঘণ্টাখানেক ইচ্ছেমতো তাণ্ডব চালিয়েছিল জামায়াত শিবির কর্মীরা৷ অতর্কিত হামলায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি পুলিশও এগিয়ে আসেনি বাধা দিতে৷
বাঁশখালি থেকে ঘুরে আসার ঠিক এক সপ্তাহ পর আমরা গিয়েছিলাম গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে৷ সেখানে দেখেছি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে ঘরবাড়ি৷ রাস্তার পাশে সারি সারি দোকানে ভাঙচুর চালিয়ে বাজারগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে জামায়াত-শিবির কর্মীরা৷ শুধু দোকানে হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাওয়ার কারণে অঙ্গচ্ছেদ করে খুনও করেছে পানের দোকানদার শরিফুল ইসলামকে৷ হামলা চালিয়েছে শরিফুলের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ওপর৷
উপজেলার কঞ্চিবাড়ি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা খাদেম হোসেন ও তার ছেলের ঘর সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দিয়েছে৷ মুক্তিযোদ্ধা, তাঁর স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে মারধর করেছে৷ দুই মেয়ের মধ্যে একজনের মাত্র তিন মাস আগে সিজারিয়ান হয়েছিল এবং তার সেলাইয়ের জায়গায় লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে৷ জ্বালিয়ে দিয়েছে সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার সভাপতি কাকলী বেগমের বাড়ি-ঘর৷ তাঁর বাড়ির সাথে সাথে পুড়ে ছাই হয়েছে কোরান শরীফ, হারমোনিয়াম এবং বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তক৷ জামাত-শিবিরের হামলার হাত থেকে ওই এলাকার জেলে পাড়াও রক্ষা পায়নি৷ এলাকাবাসীর কাছ থেকেই জানতে পারি, অনেক হামলাকরীই তখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল৷
সেবার সবশেষে আমরা যাই খুলনার কয়রায়৷ প্রায় ২০ দিন পরে গেলেও সেখানকার অবস্থাও বাঁশখালী ও সুন্দরগঞ্জের মতোই৷ কয়রা উপজেলার আমাদী গ্রামের ধোপাপাড়ার মানুষরা জানিয়েছিলেন, জামাত-শিবির হামলা চালিয়ে তাঁদের সব কিছু লুট করে তারপর আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়িঘর৷ হিন্দু নারীদের একা পেয়ে মারধর করে ঘরে আটকে বাইরে থেকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং বাচ্চাগুলোকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টাও করেছিল হামলাকারীরা৷
অমিয় দাশের চার বছরের বাচ্চা মেয়েটাকে আগুনে ছুঁড়ে মারতে গেলে ওর মা এসে কেড়ে নিয়ে বাঁচিয়েছিল৷ তারপর মা-কেই বেঁধে পেটানো হয়৷ বৃদ্ধা শ্বাশুড়িকেও ছাড়েনি জামায়াত-শিবির৷ হামলার সময় হামলাকারীরা চিৎকার করে বলেছে, ‘‘পুজা মারাও শুয়োরের বাচ্চারা, পুজা মারাও৷ পুজা করিয়ে দিচ্ছি তোদের জন্মের মতো৷''
সংখ্যালঘুদের ওপর জামায়াত-শিবিরের বর্বরতার সময় একটা মানবিক কর্মের সাক্ষীও হয়েছে কয়রার মানুষ৷ গান পাউডারে বাড়ি-ঘর যখন পুড়ছিল, তখনই ত্রাণকর্তা হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন এলাকার এক শ্রমিক৷ তিনি আরো বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন সংখ্যালঘুদের৷ অবশ্য তারপরও কয়রার কয়েকটি পরিবারকে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় খোলা আকাশের নীচে অথবা গোয়াল ঘরে রাত কাটাতে হয়েছে৷
তখনও জানতাম না এমন ধ্বংসলীলা ৯ মাসের মাথায় আবারো দেখতে হবে৷ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং আবারো শুরু হয়ে যায় অমুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা৷ বাংলাদেশে নির্বাচন হলেই অমুসলিমদের ওপর হামলা হবে এটা যেন অনিবার্য৷
৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগের দিন, অর্থাৎ ৪ তারিখ দিনাজপুরের কর্ণাই গ্রামের কিছু এলাকায় ভোট দিতে না যাওয়ার জন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হুমকি দেয়া হয়৷ তারপরও তারা ভোট দিতে গেলে নির্বাচনের রাতে নিরস্ত্র হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষরূপী কিছু পশু৷ দুঃখজনকভাবে সরকার ও প্রশাসন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়৷ এই ভীত-সন্ত্রস্ত ও প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোকে দেখে দুমড়ে-মুচড়ে যেতে থাকে মনের ভেতরটা৷ কিন্তু আমরা এটাও তখন বুঝতে পারছিলাম, যেতে হবে আরো অনেক জায়গায়, দেখতে হবে আরো অনেক কান্না৷
২০১৪ সালের ১০ই জানুয়ারি দিনাজপুরের কর্ণাইয়ে থাকা অবস্থাতেই শুরু হয় আমাদের গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে যাওয়ার প্রস্তুতি৷
১১ তারিখ আমরা পৌঁছাই সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কূপতলা এলাকা (বেড়াডেঙ্গা বাজার) এবং রামজীবন ইউনিয়নের ‘কে কয় কাশদহ' গ্রামের ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে৷ বেড়াডেঙ্গা বাজার এলাকায় ভোটকেন্দ্র লাগোয়া বেশ কিছু হিন্দু বাড়িতে জামায়াত-শিবির হামলা করে৷ তবে এলাকার মানুষ হামলার কারণে মানসিকভাবে কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত থাকলেও শারীরিক ও আর্থিকভাবে খুব একটা ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি৷
কে কয় কাশদহ গ্রামে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বর্মণ নামে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পরিবারের সাথে আমাদের পরিচয় হয়৷ সত্যেন্দ্রনাথ বর্মণ জামাত-শিবিরের হামলা চলার সময়ে স্বচক্ষে তাদের তাণ্ডব পর্যবেক্ষণ করেন৷ তাণ্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিলে হামলাকারীরা তাঁর বাড়ির সামনের মন্দিরে আগুন দেয়, দেব-দেবীর মূর্তি ভাঙচুর করে এবং বাড়িতে হামলা করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়৷ সেদিনই মারাত্মকভাবে আহত হন সত্যেন্দ্রনাথ বর্মণ এবং তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ ভর্তির তৃতীয় দিনের মাথায় মানসিকভাবে মারাত্মক বিপর্যস্ত সত্যেন্দ্রনাথ বর্মণ মারা যান৷ তাঁর স্ত্রী, এক মানসিক প্রতিবন্ধী পুত্রসন্তান এবং একটি অবিবাহিত কন্যাসন্তান নিয়ে অকূল পাথারে পড়েন৷ সত্যেন্দ্রনাথ বর্মণের পরিবারের শুধুমাত্র ভিটেটুকু ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই৷
এরপর একে একে আমরা যাই যশোরের অভয়নগর, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে৷ সবখানেই সাম্প্রদায়িক হামলার একই চিত্র৷
এরও ঠিক এগারো মাস পরে আমাদের আবারো দেখতে হয় অমুসলিম জনগোষ্ঠীর হাহাকার৷ কিন্তু এবার হিন্দুদের ওপর জামাত-শিবিরের হামলা না, বৌদ্ধ চাকমাদের ওপর বাঙালিদের হামলা৷
পৌষ মাসের শীতে বাড়িঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নীচে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা৷ সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ঘটনাটা ঘটেছিল মহান বিজয় দিবসে৷ ৪৩ বছর আগে যে দিনে নিজেদের একটা ভূখণ্ড হানাদার পাকিস্তানিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম আমরা সম্প্রীতির সাথে মিলে মিশে থাকার প্রত্যয় নিয়ে, ঠিক সেই দিনটিতে আমরাই হামলে পড়লাম শান্তিপ্রিয় চাকমা নৃগোষ্ঠীর ওপর৷
১৬ই ডিসেম্বর, ২০১৪৷ রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় আনারস বাগান নিয়ে বিরোধে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অর্ধশতাধিক বাড়িঘর ও দোকানে অগ্নিসংযোগ করে একদল বাঙালি৷ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় উপজেলার ৩টি গ্রামের মোট ৬১টি পরিবার৷
এত হামলা, এত অত্যাচার, এত হাহাকার দেখার পরেও এটাই এ পর্যন্ত আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা৷
রাঙামাটির ওই প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পুড়িয়ে দেয়া হয় বাড়িঘর-দোকানপাট, নতুন তোলা আমন ধান৷ এমনকি গুরুত্বপূর্ণ দলিল, সার্টিফিকেট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও রক্ষা করতে পারেনি অসহায় মানুষগুলো৷ অভিমানে, ক্ষোভে তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দেয়া এই মানুষগুলো আমাদেরকে ঠিকই আপন করে নিয়েছিল, শুনিয়েছিল তাদের দুর্দশার কথা৷
এক চাকমা মা কোনোমতে তাঁর ৬ মাসের বাচ্চাকে একটা পাতলা কম্বলে ঢেকে রেখেছিলেন৷ কিন্তু তাও পাহাড়ের ঠান্ডায় কাবু হয়ে গিয়েছিল বাচ্চাটি৷ আরেক পোড়া বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম করুণতম দৃশ্য৷ ছোট্ট ৩ বছরের ফুটফুটে একটা বাচ্চা পোড়া কাঠের কালিতে মাখামাখি হয়ে ছাইয়ের ওপর বসে পোড়া কাঠ-কয়লা দিয়েই বানাচ্ছে খেলনার উপকরণ৷ পাশের গ্রামেই আবার এক থুড়থুড়ে বৃদ্ধা সম্পূর্ণ ভস্মিভূত বাড়ির সামনে ছাইয়ে বসে নিজের মনেই হাসছেন৷
আমাদের একটা সংগঠন আছে, নাম ‘আমরা - অ্যালায়েন্স ফর মিটিগেটিং রেসিজম অলটুগেদার'৷ এ সংগঠনের কাজই সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো৷
আমরা সত্যিই চাই এই সংগঠনটি একদিন কাজের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাক৷ বিলুপ্ত হোক বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা৷
সায়ন্তনী ত্বিষা ‘আমরা’ নামের একটি অলাভজনক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত৷ ‘আমরা’ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার শিকার সংখ্যালঘু এবং নানান দুর্যোগ, দুর্ঘটনার শিকারদের সহায়তা করে৷
(এ লেখায় লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণই প্রকাশিত৷ ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগ এ লেখার কোনো বক্তব্য বা তথ্যের জন্য দায়ী নয়৷)
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷