কোথায় থাকবে ইয়াজিদিরা?
৬ আগস্ট ২০১৮ইরাকের উত্তরাঞ্চলের শহর সিনজার৷ বংশপরম্পরায় এ শহরটিতে বসবাস করে আসছিল দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ইয়াজিদিরা৷ সে স্মৃতি আর অবিশষ্ট নেই৷ ভেঙে পড়া দালান-কোঠা আর ইট-পাথরের স্তূপ দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত৷ শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ! বড় কোনো হাতুড়ি দিয়ে যেন কেউ নরকের আকৃতি দিয়েছে শহরটাকে৷ স্থবির হয়ে আছে সব কিছু, এমনকি ঘড়ির কাঁটাও যেন থমকে গিয়ে সাক্ষী দিচ্ছে ধ্বংসযজ্ঞের৷
নভেম্বর ২০১৫ সালে, অ্যামেরিকান আর্মির সহায়তায় কুর্দি যোদ্ধারা ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে শহরটিকে৷ এক বছরেও বেশি সময় এ জঙ্গি গোষ্ঠিটির নিয়ন্ত্রণে ছিল শহরটি৷ আইএস-এর হাত থেকে মুক্তি মিললেও, তুরস্কের বিমান হামলা বাসিন্দাদের মাতৃভূমির উপর ধ্বংসযজ্ঞকে দীর্ঘায়িত করে৷
মেয়রের সাথে সাক্ষাৎ
প্রায় তিন বছর আগে উদ্ধার হওয়া এ শহর পূনর্গঠনের কোনো দৃশ্যমান চিহ্ন নেই৷ স্থবির হয় আছে সব কিছু৷ অথচ মাত্র ৭৫ মাইল দূরে অবস্থিত মসুল শহরের চিত্র ভিন্ন৷ প্রায় এক বছর আগে মসুল শহরটিকে আইএস-এর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা হয়৷ শহর পুননির্মাণের কাজও এগিয়ে চলছে দৃশ্যমান গতিতেই৷ কিন্তু তিন বছর আগে উদ্ধার হওয়া সিনজার শহরের পুনর্গঠন কাজ মসুল শহররে তুলনায় বড্ড বেমানান৷ রাস্তা থেকে ইট পাথর সরিয়ে নেয়া হলেও চোখে পড়েনি কোনো অবকাঠামো পুননির্মাণ কাজ৷
শহরটির আশপাশের বসতগুলোও রেহাই পায়নি ধ্বংসযজ্ঞ থেকে৷ সিনজান শহরতলির এমনি একটি এলাকা হেরদান৷ নিজেদের জীবন বাঁচাতে সেখান থেকে পালিয়ে গেছেন বাসিন্দারা৷ প্রবেশ পথেই চারটি গণকবর চোখে পড়ে৷ সবুজ ঘাসে লতানো কবরগুলো৷ জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যাওয়া বাসিন্দাদের একজন হাসান খালাফ৷ এ এলাকায় প্রায় তিনশ'র মতো পরিবার বাস করত৷ এ সংখ্যা এখন মাত্র ৬০, জানালেন হাসান৷ বাকি পরিবারগুলো কোথায় জানতে চাইলে কোনো সঠিক খবর দিতে পারেননি তিনি৷ গণকবরগুলোর পাশের একটি জায়গা দেখিয়ে বললেন, ‘‘নিখোঁজ হওয়া অনেককেই এ জায়গাটিতে এনে হত্যা করেছে জঙ্গিরা৷ প্রায় পাঁচশ'র মতো নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে গেছে ওরা৷''
এখানকার বাসিন্দাদের জন্য কোনো সরকারি সহযোগিতা কেন আসছে না, জানতে চাইলে শহরটির ভারপ্রাপ্ত মেয়র ফাহাদ হামিদ উমার বলেন, ‘‘সহযোগিতা আসছে না, কারণ আমরা ইয়াজিদি৷ আমরা এ দেশের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণির নাগরিক, দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা আমাদের বিষয়ে আগ্রহী নন৷''
ফাহাদ নিজেও একজন ইয়াজিদি৷ অন্য সব মেয়রের মতো ফাহাদ স্থানীয় কুর্দিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে না থেকে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে সিনজার অঞ্চলটি পরিচালনা করতে চান৷ তাঁর কথায়, ‘‘অমরা চাই সিনজার সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকুক৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এবং কুর্দিদের ক্ষমতার লড়াইয়ের মাঝে ইয়াজিদিরা জিম্মি হয়ে আছে৷ সিনজারের প্রশাসনিক কার্যক্রম যদি সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হতো, তাহলে আমাদের এভাবে নির্যাতন সহ্য করতে হতো না,’’ স্থানীয় কুর্দি বাহিনীর প্রতি এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফাহাদ৷
যেদিন পালটে যায় সব কিছু
আগস্ট ৩, ২০১৪ সালে আইএস-এর একটি দল প্রথম সিনজার শহরে প্রবেশ করে৷ তার আগে জুন মাসে কট্টরপন্থি সুন্নিরা সিনজার থেকে ৭৫ মাইল দূরে অবস্থিত ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল দখল করে নেয়৷ মসুল দখলের পর কট্টরপন্থি সুন্নিদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে ইয়াজিদিদের নির্মূল করা৷ কট্টরপন্থি সুন্নিদের চোখে ইয়াজিদিরা হলো ‘অবিশ্বাসী, যারা শয়তানের পূজা করে৷'
সিনজার শহরটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে হলেও সেখানে মূলত কুর্দিদের প্রতি আনুগত্য পোষণকারী পেশমেরগা বাহিনীর প্রভাব ছিল৷ কিন্তু আইএস সদস্যরা এ শহরে প্রবশের সময় পেশমেরগা বাহিনী কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি, বরং তারা নীরবে এ এলাকা ত্যাগ করে৷ ফলে ইয়াজিদি জনগোষ্ঠী হয়ে পড়ে নিরাপত্তাহীন৷
যুদ্ধে মারা যাওয়া ইয়াজিদিদের সঠিক সংখ্যা কেউ জানে না৷ তবে নিহত ও নিখোঁজের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার বলে দাবি মেয়র ফাহাদের৷ তার ভাষ্যমতে, প্রায় সাত হাজার নারী ও শিশুকে তারা বন্দি করে নিয়ে গেছে, যাদের অধিকাংশই এখনো নিখোঁজ৷
ইরাকের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা এটাই প্রথম নয়৷ তবে নির্যাতনের দিক থেকে এটি ছিল ভয়াবহ৷ আন্তর্জাতিক ইয়াজিদি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ইরাকে বাস করা ইয়াজিদি গোত্রের প্রায় আড়াই লাখ মানুষ সিনজার শহর ও তার আশপাশের এলাকায় বাস করতেন৷ অধিকাংশ ইয়াজিদি জীবন বাঁচাতে তাঁদের মাতৃভূমি ত্যাগ করেন, পরবর্তীতে যাদের অনেকেই জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন৷ জার্মানির ফেডারেল অফিস ফর মাইগ্রেশন-এর তথ্য অনুযায়ী, ৯৭ হাজার ১৬২ জন ইরাকি নাগরিক ২০১৬ সালে জার্মানিতে অশ্রয়ের আবেদন করেন, যাঁদের মধ্যে ৩৭ হাজার ৬৫৫ জন ইয়াজিদি গোত্রের৷ ২০১৭ সালে আবেদন করেছিলেন মোট ২৩ হাজার ৬০৫ জন, যাঁর মধ্যে ১১ হাজার ২০০ জন ছিলেন ইয়াজিদি৷
সিনজিয়া দখলে জড়িত যারা
নিষিদ্ধ ঘোষিত কুর্দিস্তান ওয়ার্কাস পার্টি (পিকেকে) ও সিরিয়ান কুর্দস (ওয়াইপিজে) ২০১৪ সালের আগস্টে সিনজিয়া অঞ্চলের একটি করিডোরের নিয়ন্ত্রণ নেয়৷ প্রায় ৫০ হাজারের মতো ইয়াজিদি এ সময় জীবন বাঁচাতে তাদের ধর্মীয় স্থান সিনজার পর্বতের উপত্যকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ প্রায় এক বছরের অধিক সময় পিকেকে ও ওয়াইপিজে সিনজারে ঘাঁটি গেঁড়ে থাকা আইএস জঙ্গিদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যায়৷ এদিকে ২০১৭ সালে বিতর্কিত এক গণভোটের পর পেশমেরগা বাহিনীকে সরিয়ে নেয়া হলে ইরাকি আর্মি ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী হাস্দ-আল-শাবি সিনজার অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়৷ ওদিকে তুরস্ক সিনজার অঞ্চলে সামরিক অভিযানের হুমকি দিলে ওই অঞ্চল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দখলদারিত্বের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে৷ ফলে ইয়াজিদিরা হয়ে ওঠেন স্বভূমিতে নির্যাতিত ও সেখান থেকে বিতাড়িত এক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী৷
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার এ লড়াই একদিকে যেমন হাজার হাজার ইয়াজিদির জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্যদিকে দেশটির সংখ্যালঘু এ সম্প্রদায় ধীরে ধীরে হারিয়েছে স্বভূমি ফিরে পাওয়ার আশা৷
স্টেওয়ান ইলিয়াস, সিনজারের অধিবাসী ও একজন স্কুল শিক্ষক৷ তিনি জানান, এখানে বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের অধিপত্য প্রতিষ্ঠায় একে-অপরের সাথে যুদ্ধ করছে৷
‘‘মাতৃভূমি ফিরে পেতে, ইয়াজিদিরা কার কাছে সাহায্য চাইবে?’’
শহর পুনর্গঠনের জন্য কোনো আর্থিক সহযোগিতা নেই জানিয়ে ইলিয়াস বলেন, সবাই জানে সিনজার তাদের জন্য নিরাপদ নয়, তাই তারা ফিরে আসতে চায় না৷
একই কথা বললেন বারান খারো, যদিও প্রথমে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্যই করতে চাননি তিনি৷ তাঁর চাচার পরিবার এখনো আইএস-এর হাতে বন্দি, মৃদু স্বরে জানালেন তিনি৷ এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই, নেই খাবার পানি, চারদিকে এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের কঙ্কাল, জানালেন খারো৷
‘‘এটা একটা মৃত্যুপুরী, আমরা খুব আতঙ্কিত৷''
সহায়তার দাবি
মেয়র ফাহাদ জানান, আইএস জঙ্গিরা এখানে সীমাহীন অত্যাচার চালিয়েছে৷ শুধু ইয়াজিদিদের ওপর নয়, এখানে বসবাসকারী কোনো জাতিগোষ্ঠীই রেহাই পায়নি তাদের হত্যাযজ্ঞ থেকে৷ তবে এখন তাঁদের প্রধান আতঙ্ক সিনজারে অবস্থান নেয়া সুন্নি আরব ও তুর্কি সেনাদের নিয়ে৷
‘‘আমাদের অনেক মুসলিম প্রতিবেশী আইএস যোদ্ধাদের সমর্থন করেছে,'' বললেন ফাহাদ৷
ইয়াজিদিদের বাঁচাতে এখন আন্তর্জাতিক পদেক্ষপ প্রয়োজন বলে মনে করেন ফাহাদ৷ ইরাক সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি জানিয়েছেন তিনি৷
‘‘আমরা চাই, সরকার সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে এ অঞ্চলে না পাঠিয়ে সরাসরি আমাদের সহায়তা করুক৷''
এ অঞ্চেল বসবাসকারী সুন্নিদের আচরণেও ক্ষুব্ধ তিনি়৷
‘‘সিনজারে যখন আইএস-এর ঘাঁটি ছিল, সুন্নিরা তখন তাদের সহায়তা করেছে আমাদের হত্যা করতে৷''
ইয়াজিদি ও সুন্নি-এ দুই এলাকার মাঝে একটি দেয়াল নির্মাণ করতে চান তিনি, ভুলে যেতে চান সুন্নিদের সাথে ঘটে যাওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা৷
সান্দ্রা পেটার্সমান/আরআর