মস্তিষ্কের সঙ্গে ‘কথা বলে' অন্ত্র
৩ ডিসেম্বর ২০১৮খোশমেজাজ নাকি মনমেজাজ ভালো নেই? নিশ্চিন্তে রয়েছেন, নাকি উদ্বেগে ভুগছেন? খিদে মিটছে না, ফলে মোটা হয়ে যাচ্ছেন? নাকি বেশ রোগাপাতলা হয়ে গেছেন?
এ সবের জন্য আমাদের আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়া দায়ী হতে পারে৷ আমাদের জীবনের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কতটা, গবেষকরা ধীরে ধীরে তা জানতে পারছেন৷ চিকিৎসক হিসেবে প্রো. মিশায়েলা আক্সট-গাডেরমান মনে করিয়ে দেন, ‘‘আমাদের অন্ত্রের মধ্যে ১০০ ট্রিলিয়ন, অর্থাৎ ১ কোটি কোটি জীবাণু রয়েছে, শরীরে কোষের সংখ্যার তুলনায় যা ১০ গুণ বেশি৷ সেই জীবাণুর নিজস্ব চরিত্র মোটেই ভালো বা খারাপ হয় না৷ আমাদের স্বাস্থ্য ও ভালো থাকার জন্য এই জীবাণু অত্যন্ত জরুরি৷ জীবনধারা ও খাদ্যের মাধ্যমে আমরাই বরং তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করি৷''
অন্ত্রের মধ্যে এই জীবাণু এমনকি আমাদের মস্তিষ্কের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করে৷ মিশায়েলা আক্সট-গাডেরমান তা নিয়ে গবেষণা করছেন৷ সবার আগে ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে৷ কিছু ইঁদুরকে এমন খাবার দেওয়া হয়েছে, যাতে ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া মেশানো রয়েছে৷ বাকিদের স্বাভাবিক খাবার দেওয়া হয়েছে৷ কিছুক্ষণ পর এক গোলকধাঁধার মধ্যে সব ইঁদুর ছেড়ে দিয়ে সেগুলির আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে৷
বিস্ময়কর ঘটনা হলো, দুই দলের আচরণের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা গেছে৷ প্রো. আক্সট-গাডেরমান বলেন, ‘‘অত্যন্ত ভিতু প্রজাতির ইঁদুরকে নির্দিষ্ট জীবাণু, অর্থাৎ ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া খাইয়ে দেখা গেছে, যে তাদের সাহস অনেক বেড়ে গেছে৷ অর্থাৎ আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়া যোগ করে ইঁদুরের আচরণের উপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব৷''
কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইঁদুরের উপর পরীক্ষার ফলাফল কি মানুষের ক্ষেত্রেও খাটবে? আমরা ভিতু না সাহসি, তা কি ভালো বা খারাপ খাবারের উপর নির্ভর করে? অবশ্যই সেটা সত্য নয়৷ তবে ইঁদুর ও মানুষের অন্ত্রের গঠন ও কার্যপ্রণালীর মধ্যে অনেক মিল রয়েছে৷ এটাও ঠিক, যে আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়া দুই প্রাণীর ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য, ওজন ও আচরণের উপর প্রভাব রাখে৷
সেটা কীভাবে ঘটে, নিউরোপ্যাথোলজিস্ট হিসেবে প্রোফেসর মার্কো প্রিনৎস তা নিয়ে গবেষণা করছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘মস্তিষ্ক ও অন্ত্রের পরস্পরকে প্রয়োজন হয়৷ তাদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগও থাকে৷ তবে মস্তিষ্ক যে সরাসরি অন্ত্রের কাছ থেকে সংকেত পায়, তা জেনে আমাদের অবাক লাগছে৷ মস্তিষ্ক বিচ্ছিন্ন এক প্রণালী বলেই আমরা চিরকাল জানতাম৷ আমাদের গবেষণার ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে, যে অন্ত্রের সংকেত অবশ্যই মস্তিষ্কে পৌঁছয়৷''
বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে পেরেছেন, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে যে ইঁদুরের অন্ত্রে কোনো জীবাণু রাখা হয় নি, তার মস্তিষ্কে গুরুতর পরিবর্তন ঘটেছে৷
অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া না থাকায় মস্তিষ্কে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে৷ মাইক্রোগলিয়া নামের বিশেষ ধরনের কোষ হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অথবা পুরোপুরি লোপ পেয়েছে৷ অথচ এই কোষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ সেগুলি বাইরে থেকে জোর করে প্রবেশ করা জীবাণু ও মৃত স্নায়ুকোষ দূর করে এবং সংক্রমণের মোকাবিলা করে৷ সারা জীবন ধরে মস্তিষ্কের বিকাশের ক্ষেত্রেও সেগুলির অবদান রয়েছে৷ প্রোফেসর মার্কো প্রিনৎস বলেন, ‘‘যে ইঁদুরের অন্ত্রে জীবাণু নেই এবং যার মাইক্রোগলিয়া কোষ নিষ্ক্রিয় রয়েছে, তাকে যদি একটি খাঁচার মধ্যে স্বাভাবিক ইঁদুরের সঙ্গে রাখা হয়, তাদের মাইক্রোগলিয়া কি আবার সক্রিয় ও বিকশিত হয়ে উঠে পারে – সেটাই ছিল প্রশ্ন৷''
বাস্তবে দেখা গেল, খাঁচায় চার সপ্তাহ সহাবস্থানের পর তাদের অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা এবং মস্তিষ্কে মাইক্রোগলিয়া কোষের সংখ্যা সত্যি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে গেছে৷
স্টেফানি ক্র্যুগার/এসবি