ভোট শুরুর আগে সহিংসতার ইঙ্গিত
১৮ এপ্রিল ২০২৪পশ্চিমবঙ্গে সাত দফায় নির্বাচন হবে। গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হবে এই রাজ্যে। প্রথম দফায় উত্তরবঙ্গের তিন আসনে আগামিকাল, শুক্রবার ভোট নেয়া হবে। একের পর এক নির্বাচনে সহিংসতা ও মৃত্যুর অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হচ্ছে দেশের সরকার গঠনের নির্বাচন।
কমিশনের পরিসংখ্যান
ভোট শুরুর ঠিক আগে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগের।
গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজনৈতিক হানাহানিতে কমবেশি ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর জেলায় জেলায় সহিংসতার ছবি দেখা গিয়েছিল। এর মাত্রা আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে বোমা, গুলির ব্যবহারে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় নিয়মিত বোমাবাজি, বোমা উদ্ধার বা গুলিচালনার মতো ঘটনা ঘটে।
নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই গোটা দেশের পুলিশ, প্রশাসন পরিচালনার ভার জাতীয় নির্বাচন কমিশনের হাতে। পশ্চিমবঙ্গে একগুচ্ছ বদলির পাশাপাশি তল্লাশি অভিযান জোরদার করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুযায়ী, গত এক মাসে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মোট এক হাজার চারটি বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। বিস্ফোরক পদার্থ পাওয়া গিয়েছে ৪১ কেজির বেশি। এ ছাড়া ৩৭৮টি অস্ত্র, ৫৪৩টি কার্তুজও উদ্ধার করা হয়েছে।
মিছিলে বোমাবাজি
নির্বাচন আসার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনার পারদ চড়ছে। আশঙ্কা বাড়ছে, কত বোমা, বিস্ফোরক বা আগ্নেয়াস্ত্র এখনো দুষ্কৃতীদের নাগালে রয়ে গেল! আশঙ্কা সত্যি করে বোমাবাজি, গুলিচালনার মতো ঘটনা ঘটে গিয়েছে গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে।
বুধবার বিকেলে রামনবমী উৎসব উদযাপন সমিতি মুর্শিদাবাদের শক্তিপুর বাজারে মিছিল করে। অভিযোগ, সেই মিছিলে ইট ছোড়া হয়। পাল্টা মিছিল থেকেও ইট ছোড়া হলে সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এরই মধ্যে বোমা পড়ে বলে অভিযোগ। বোমাবাজির মধ্যেই আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় কয়েকটি দোকানে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায় পুলিশ। লাঠিচার্জ করা হয়। আহত হন বেশ কয়েকজন।
বোমা বিস্ফোরণ ও উদ্ধার
আচমকা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে জামুড়িয়ার বাগডিহা গ্রাম। বুধবার রাতে স্থানীয় বাসিন্দা তপন শীলের বাড়ির শৌচালয়ের ছাদে বোমা বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তপনের বাড়ি-সহ আশপাশের কিছু অংশ। বাড়ির ছাদে কীভাবে বোমা এল?
বীরভূমের পানুরিয়া গ্রামের বিজেপি নেতার দোকানে মিলল বোমা। নিশিকান্ত অধিকারী স্থানীয় মণ্ডলের সদস্য। বুধবার গভীর রাতে তিনি দেখেন, তার দোকানের চালে দু'টি তাজা বোমা রাখা আছে। বিস্ফোরণের আশঙ্কায় দোকানটিকে ঘিরে রাখে পুলিশ।
মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞা থানার পাঁপড়দহ গ্ৰামে বোমা মিলেছে। এক সিভিক ভলান্টিয়ারের বাড়ির পাঁচিলের পাশ থেকে উদ্ধার হয় বালতি ভর্তি তাজা বোমা। পুলিশ বোমা নিষ্ক্রিয় করে।
প্রকাশ্যে গুলি
পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু এলাকা ও লোকসভা কেন্দ্র খুবই উত্তেজনাপ্রবণ ও স্পর্শকাতর। এর মধ্যে অন্যতম উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়া কেন্দ্র। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়ে ফের পদ্মের টিকিটে লড়ছেন অর্জুন সিং। তার বিরুদ্ধে রাজ্যের শাসকদলের প্রার্থী মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক।
ভাটপাড়া পুরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে এক তৃণমূল সমর্থক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তার নাম পিন্টু চৌহান। তিনি পেশায় জুটমিলের কর্মচারী। বিজেপি কর্মী প্রকাশ চৌধুরীর বিরুদ্ধে গুলিচালনার অভিযোগ উঠেছে। বুধবারের এই হামলার কারণ রাজনৈতিক না ব্যক্তিগত, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কারণ যাই হোক, এভাবে প্রকাশ্যে যত্রতত্র গুলি ও বোমার ব্যবহারে আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ।
এই আতঙ্ক দূর করতে সাবেক এনএসজি আধিকারিক দীপাঞ্জন চক্রবর্তীর পরামর্শ, "জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে সতর্কতামূলক গ্রেপ্তারি করতে হবে। দণ্ডবিধির ১৫৭ ও ১০৭ নম্বর ধারা অনুসারে, সমাজের শান্তি বিঘ্নিত করতে পারে, এমন কাউকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। এতে জামিন পাবে না ধৃত। কম করে তিন সপ্তাহ জেল হেফাজতে রাখা যেতে পারে। এটা না করলে সমাজবিরোধীদের হাত থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেও লাভ হবে না।"
বিরোধীদের অভিযোগ, রাজ্যের সর্বত্র শাসক দলের মদতে বোমা, গুলির কারবার চলছে। এই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণে তারা সামনে রাখছে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা, ভূপতিনগরে বিস্ফোরণকে। দুটি ক্ষেত্রেই অনেকে হতাহত হয়েছেন, এর মধ্যে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও আছেন। তাই শাসক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে।
দুই হাতে তালি
বিরোধীদের হাতেও যে বোমা, গুলির যোগান রয়েছে, সেটাও ঘটনা প্রবাহে বোঝা যায়। আগ্নেয়াস্ত্রের সরবরাহ থাকলে যে দুই পক্ষের লাভ, তা স্পষ্ট। বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূলের নেতা, কর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। মোটের উপর, বারুদ-বিস্ফোরক সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডব্লিউকে বলেন, "শাসক দল চেষ্টা করে যাতে সাধারণ ভোটারকে প্রভাবিত করা যায়। তাদের ভয় দেখালে তারা ভোটদানে বিরত থাকবেন। সেই জায়গায় ছাপ্পা ভোট পড়ে যাবে। এই পরম্পরা অনেকদিন ধরেই চলছে। মানুষ তার জীবন রক্ষা করতে ভোটদানে পিছিয়ে যায়। এভাবেই প্রতিবার ভোট পর্ব মেটে।"
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আতঙ্কিত ভোটকর্মীরা। শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক, শিক্ষক কিংকর অধিকারী বলেন, "ভোট যত এগিয়ে আসছে, তত এই ধরনের ঘটনা বাড়বে। এখন জোর যার মুলুক তার। শাসক হোক বা বিরোধী, প্রত্যেকেই চেষ্টা করে অর্থ ও পেশি শক্তি ব্যবহার করে ভোটে জিততে। এটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়।"
প্রলোভনের হাতছানি
শুধু ভয় দেখানো নয়, ভোটারদের বাগে আনতে টাকা ও নেশার সামগ্রী বিলির প্রবণতাও আছে। কমিশনের পরিসংখ্যান বলছে, পয়লা মার্চ থেকে বাংলায় মোট ২৩৬ কোটি টাকার সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে নগদ টাকা প্রায় ১৪ কোটি।
কমিশন বাজেয়াপ্ত করেছে মোট ২২ লক্ষ লিটার মদ, এর মূল্য ৫৫ কোটি টাকা। ছয় হাজার কেজির বেশি মাদকও উদ্ধার করা হয়েছে। কেন এতদিন এসব রাজ্যে বেআইনিভাবে রাখা হয়েছিল, সে প্রশ্ন উঠছে।
দুই বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী বলেন, "খুবই হতাশ লাগে, কীভাবে বাঙালির সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ক্ষয় হয়ে গেল। রাজনৈতিক নেতারা এত অদূরদর্শী যে সামান্য স্বার্থের জন্য মূল্যবোধকে অস্বীকার করেন। তবু আশা করব, শান্তিপূর্ণভাবে ভোট পর্ব মিটলে ভালো লাগবে। কিন্তু আমারও ভয় করে, বুক দুরদুর করে।"