ভিশনহীন টেলিভিশন
৫ জুলাই ২০১৯বহুমুখী সংকটে বাংলাদেশের টেলিভিশন খাত৷ সহসা ঘুরে দাড়াবে এমন কোনো ইঙ্গিতও নেই৷ বরং খাতটির সর্বক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, হতাশা৷ পেশাদারিত্বের অভাব৷ দক্ষ ও মেধাবীরা কোণঠাসা৷ বেতন-বোনাস, বাড়তি সুযোগ-সুবিধার আলোচনার সুযোগও সীমিত৷ সৃজনশীলতা ও সৌন্দর্য প্রায় অনুপস্থিত৷ দেশে চ্যানেল সম্প্রচারে আছে ৩০টি৷ এর মধ্যে ক'টি যে ঠিকঠাক ‘টেলিভিশন' হতে পেরেছে, সে এক বড় প্রশ্ন৷ এমন পরিস্থিতিতে পেশা ছেড়েছেন এবং ছাড়তে চান অনেকেই৷
বেশিরভাগ টেলিভিশনে সময়মতো বেতন হয় না৷ গোপনে ও প্রকাশ্যে ছাটাই নিয়মিত ঘটনা৷ মানসম্মত অনুষ্ঠানের অভাব, অপ্রতুল আয়, দক্ষকর্মী-নতুন পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের অভাবে চ্যানেলগুলোর অবস্থা করুণ৷ এ খাতের কর্মীদের বিরাট এক অংশ বিশ্বাস করে, টেলিভিশনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই৷ এর সংকট অনিরাময়যোগ্য৷ তাছাড়া চ্যানেলগুলো কতটা গণমাধ্যম আর প্রচারমাধ্যম এ নিয়েও বিতর্ক প্রবল৷ টেলিভিশন গণমাধ্যম হলেও, পর্দাজুড়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের দাপট৷ ‘গণ' উপস্থিতি নগন্য৷
দেশের বিজ্ঞাপনের বাজার ছোট, সে তুলনায় চ্যানেল সংখ্যা অনেক বেশি৷ বেশিরভাগ যেখানে ব্যবসা করতে পারছে না, সেখানে বেশ ক'টি চ্যানেল আবার সম্প্রচারের অপেক্ষায়৷ এগুলো সম্প্রচারে এলে খাতটিতে কী অবস্থা তৈরি হবে? এগুলো চালাবে কারা? বিজ্ঞাপন পাবে কোথায়? লাইসেন্স প্রদানের সময় এসব ভাবা হয় না৷ বিবেচিত হয় লাইসেন্স কে চাচ্ছে!
টেলিভিশন হচ্ছে ব্যবসা, যেখানে লাভ-লোকসানই শেষ কথা৷ অথচ সম্প্রচারে থাকা চ্যানেলগুলো বেশিরভাগই ‘দিন আনি দিন খাই'র মতো অবস্থা৷ তা-ও বেশিরভাগের চলতে-চালাতে কষ্ট হচ্ছে৷ কারণ, কারো কোনো বিশেষত্ব নেই৷ প্রায় সবার অনুষ্ঠান বা খবর একই রকম৷ এমনকি ধরনও৷ লোগো ছাড়া কাউকে আলাদা করা কঠিন৷ খাতটির কর্মীরা হতাশাগ্রস্থ এবং বহুভাগে বিভক্ত৷ পেশাদারিত্বের অভাব প্রকট৷ এর ওপর আন্তর্জাতিক টেলিভিশনের আগ্রাসনে স্থানীয়রা কোণঠাসা৷ সবমিলিয়ে সম্প্রচারখাত ভয়ানক চাপে, যা মোকাবিলায় প্রয়োজন সরকারি ও খাতসংশ্লিষ্টদের সম্মিলিত উদ্যোগ৷
বিজ্ঞাপননির্ভর টেলিভিশন খাত এখন কোথাও নেই৷ ভারতেও এই অভিজ্ঞতা প্রায় এক দশকের৷ টেলিভিশনগুলোর প্রধান আয়ের খাত হচ্ছে সাবস্ক্রিপশন বা গ্রাহক ফি, যেখানে বিজ্ঞাপনের হিস্যা ৪০ শতাংশেরও কম এবং দিন দিন তা আরো কমছে৷ সেখানে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো পুরোটাই বিজ্ঞাপননির্ভর৷ ধারণা করা হয়, সম্প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের বাজার ১ হাজার কোটি টাকা বা তার কিছু বেশি৷ এর একটা অংশ আবার চলে যাচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে৷ অন্যদিকে অভিযোগ আছে, ভারতে বিজ্ঞাপন পাচার হচ্ছে, যা নিয়ে স্থানীয় টেলিভিশন মালিক ও কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ আছে৷
দুএকটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ভারতীয় চ্যানেলে প্রচারিত হয় সত্য, কিন্তু কত টাকার বিজ্ঞাপন ভারতে পাচার হচ্ছে, এর সঠিক কোনো তথ্য কোথাও নেই৷ তবে ভারতে বাংলাদেশি কিছু পণ্যের চাহিদা আছে৷ এবং বাস্তবতা হচ্ছে, যেসব ভারতীয় চ্যানেলে এ দেশীয় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়, ওই চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে ভীষণ জনপ্রিয়৷ এর সুযোগটা নিচ্ছে বা নিয়েছে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো৷ ভারতীয় চ্যানেলে প্রচার বন্ধ হলে ওই বিজ্ঞাপন স্থানীয় চ্যানেলগুলো পাবে কিনা, তাতে টেলিভিশন খাতের আর্থিক সংকট কাটবে কিনা-এসব প্রশ্ন অমীমাংসিত৷
তবে বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনসহ বিদেশি চ্যানেল আইনত অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারে না৷ দুনিয়াজোড়া নিয়ম হচ্ছে, বিদেশি চ্যানেলের পরিবেশক বা ক্যাবল অপারেটররা ক্লিনফিড ডাউনলোড করবে, এরপর স্থানীয়ভাবে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে তা অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রচার করবে৷ আইনত অপারেটর বা পরিবেশকদের সে সুযোগও এখানে নেই৷ সবমিলিয়ে শুরু থেকে এদিকটায় নজর না দেয়ায় বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনসহই অনুষ্ঠান প্রচার করে আসছে৷ ফলে প্রচুর রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার. যা বন্ধে সম্প্রতি ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান শুরু করেছে৷ যার তীব্র বিরোধিতা করে ‘ক্যাবল নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন-২০০৬' সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন ক্যাবল অপারেটররা৷
বাস্তবতা হচ্ছে, ক্লিন ফিডের যে দাম তা কেনার সামর্থ্য স্থানীয় গ্রাহকদের নেই৷ অন্যদিকে, বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান প্রচার আইনের লংঘন৷ এ অবস্থায় আইন সংশোধন করতেই হবে৷ অন্যথায় পাইরেটেড চ্যানেল চালাবে অপারেটরা৷ কারণ, স্থানীয় দর্শকদের কাছে বিদেশি (ভারতীয়) চ্যানেলগুলোর চাহিদা ব্যাপক৷ এ অবস্থায় আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত বিদেশি টেলিভিশনের ল্যান্ডিং ফি বাড়িয়ে কয়েক কোটি টাকা করা এবং প্রচারিত বিজ্ঞাপনের আয়ের হিস্যা দাবি করতে পারে সরকার৷
দর্শক, স্থানীয় চ্যানেল কেন দেখবে খাত সংশ্লিষ্টদের সেই আত্নজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন৷ স্মরণে রাখা উচিত, অনুষ্ঠান ভালো না হলে, দর্শক টিভি দেখবে না৷ কারণ, তার সামনে অনেক বিকল্প৷ দর্শক নেই মানে বিজ্ঞাপনও নেই৷ বিজ্ঞাপন না এলে আয় বন্ধ৷ আয় না হলে বেতন-বোনাস, সুযোগ-সুবিধা সব বন্ধ৷ ফলাফল কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের রুগ্নতা অনিবার্য৷ এ অবস্থা ঠেকাতে কন্টেন্টকে ন্যুনতম আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতেই হবে৷ কন্টেন্ট ও মানবসম্পদে বিনিয়োগ এবং কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে৷ মালিকদের ‘টেলিভিশন'কে সিকিউরিটি নয়, ব্যবসা হিসেবে নিতে হবে৷
পাশাপাশি টেলিভিশন খাতকে রক্ষায় বিজ্ঞাপন নির্ভরতা কমাতে ডিজিটাইজেশনে যেতেই হবে৷ ডিজিটাল বাংলাদেশে অ্যানালগ টেলিভিশন চলা উচিত নয়৷ পাশাপাশি খাতটির কর্মীদের উজ্জিবীত করতে আইনীভাবে চাকরি, বেতন ভাতা ও সবরকমের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষার নিশ্চয়তার দিতে হবে৷ মালিক-কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও উদ্যোগেই কেবল খাতটিকে সব সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে৷
সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জবাবদিহিতা, সুশাসনের প্রশ্নে স্থানীয় চ্যানেলগুলোতে অনেক ভালো কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে৷ এজন্য সম্প্রচার মাধ্যমের কাছে পুরো জাতির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত৷ সব সংকটই নতুন সম্ভাবনা ও পথ নির্দেশ করে৷ বাংলাদেশের টেলিভিশন খাতেও নতুন দিনের শুরু হবে এই স্বপ্নটাই দেখছি৷