1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে আসছে ‘‌বুলেট ট্রেন’‌‌

রাজীব চক্রবর্তী নতুন দিল্লি
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে মুম্বাই-‌আহমেদাবাদের মধ্যে ‘‌বুলেট ট্রেন’‌ চালু করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ অর্থ, প্রযুক্তি সব দিয়ে সাহায্য করছে জাপান৷ নানা প্রশ্ন উঠছে এই প্রকল্প নিয়ে৷

https://p.dw.com/p/2kTZu
China Hochgeschwindigkeitszug Fuxing
ছবি: picture-alliance/Zumapress.com

প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে, ‘‌মুম্বই-‌আমেদাবাদ হাইস্পিড রেল'‌৷ সবকিছু ঠিকঠাক এগোলে ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট দুই শহরের দূরত্ব কমিয়ে দেবে জাপানি রেল৷

মন্দির-‌মসজিদ কিংবা হিন্দু-‌মুসলিম ছেড়ে এবার উন্নয়ন নিয়ে ভাবছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ জাপানের সহযোগিতায় ভারতের প্রথম বুলেট ট্রেন প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন তিনি৷ ‘‌এক ঢিলে দুই পাখি'‌ মারার কায়দায় মোদীর লক্ষ্য, আগামী নির্বাচনে ‘‌ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স'‌-‌এর জয় নিশ্চিত করা৷ সেইসঙ্গে প্রতিবেশী দেশ চীনের কাছে সুস্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেওয়া, ‘‘‌তোমার দরকার নেই, আমার সঙ্গে জাপান আছে৷''‌ প্রাথমিকভাবে প্রকল্প শেষ করতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময় লাগার কথা বলা হলেও মোদী চাইছেন ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট দেশবাসীকে প্রথম বুলেট ট্রেন উপহার দিতে৷

‘‌বুলেট ট্রেন'‌ এমন একটা ট্রেন হবে যা মাত্র তিন ঘন্টায় দু'টি শহরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করবে৷ এই দু'টি শহরের দূরত্বের যাত্রায় এখন দুরন্ত এক্সপ্রেস সময় নেয় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা৷ বুলেটের সর্বোচ্চ গতি হবে প্রতি ঘন্টায় ৩৫০ কি.মি.৷ এই দুই শহরের‌ মধ্যে বর্তমানে ২৫টি ট্রেন, ২০-‌টির বেশি বিমান যাতায়াত করে৷ এছাড়াও ৪০টি ট্রাভেল কোম্পানির ৯৫টি ভলভো-‌ডিলাক্স বাস যাতায়াত করে৷ এখন বুলেট যদি ১২টি স্টেশনে দাঁড়িয়ে যাতায়াত করে, তাহলে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় নেবে৷ ২৫ কি.মি. হবে সুড়ঙ্গ৷ ৭০টি হাইওয়ে এবং ২১টি নদী পার হবে বুলেট ট্রেন৷ এর জন্য ১৭৩টি বড় এবং ২০১টি ছোট ব্রিজ তৈরি করতে হবে৷ প্রথমদিকে ১০ কোচের বুলেট চলবে, যাতে ৭৫০ জনের বসার ব্যবস্থা থাকবে৷ পরে ১৬ কোচের বুলেট চালানো হবে৷ তাতে ১২০০ জন যাত্রী বসতে পারবেন৷ দিনে ৩৫ বার যাতায়াত করবে এই দ্রুতগামী ট্রেন৷

মুকুল রায়

এই প্রকল্পের ব্যয় ধার্য করা হয়েছে ১ দশমিক ‌২ লক্ষ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারের জন্য গড়ে ২৩৬ কোটি টাকা৷ এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, দেশ এবং মুম্বাই ও আমেদাবাদ শহরের কি এই ট্রেনের খুব প্রয়োজন?‌ বুলেটের পরিবর্তে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিমান পরিষেবা পরিকাঠামো উনন্নয়নে বরাদ্দ হলে তুলনামূলক বেশি লাভ হতো না?‌ বুলেট ট্রেন চালাতে যে খরচ, তাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মোট ৮০টি এইমস হাসপাতাল তৈরি করা সম্ভব হতে পারত৷ একটি এইমস গড়তে খরচ হয় দেড় হাজার কোটি৷ তাছাড়া বুলেটের জন্য বরাদ্দ ১.‌‌২ লক্ষ কোটি টাকা ভারতীয় রেলের ৫ বছরের সুরক্ষা বাবদ খরচের সমান৷ ক্রমবর্ধমান রেল দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখে যা অত্যন্ত জরুরি৷ এমনকি রেলভবনে ফাইলবন্দি ৩০০টি প্রকল্প রূপায়নে রেলের এখন প্রয়োজন দু-‌লক্ষ কোটি টাকা৷ এক বুলেট ট্রেনের টাকায় রেলের কমপক্ষে ১৫০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতো৷

প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মুকুল রায় বুলেট ট্রেন প্রকল্পের প্রশংসা করছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‌‘‌প্রযুক্তি যত এগোচ্ছে, বিভিন্ন দিকে তত ঘটনা ঘটছে৷ বুলেট ট্রেন বুলেটের গতিতে দৌড়াবে৷ ভারতের জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ৷ এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই৷'‌'

‌‌বর্তমান রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের দাবি, ‘‌‘‌১৬০ বছরের পুরোনো রেলে বুলেট ট্রেনের প্রযুক্তি অত্যন্ত জরুরি৷ শুধু মুম্বই-‌আমেদাবাদ প্রকল্পেই ২০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান হবে৷'‌'‌ রেলমন্ত্রীর আশা, এই বুলেট ট্রেনের পাশাপাশি ‘‌মেক ইন ইন্ডিয়া'‌ প্রকল্পের আওতায় ভারতে বুলেট ট্রেনের কোচ ও করিডোর তৈরির কাজ শুরু হবে, যাতে ভারত অনেক কম খরচে কোচ ও করিডোর তৈরি করতে সক্ষম হবে৷

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা তানভির নাসরিন মনে করছেন, মোদী এবার উন্নয়ন যজ্ঞে নেমেছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘‌‌বুলেট ট্রেনের প্রকল্পকে সামনে এনে মোদী বুঝিয়ে দিয়েছেন হিন্দুত্ব, গরুর বিষয়গুলিকে তিনি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন না৷ দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প শহরগুলিকে জুড়ে দিতে চাইছেন৷ এর পেছনে রয়েছে কর্মসংস্থানের বিষয়টিও৷ এটা প্রশংসনীয়৷ তাছাড়া জাপানের ঋণ দেওয়ার ইতিহাস আছে এদেশে৷ কলকাতায় গড়িয়াহাট, পার্কস্ট্রিটের উড়ালপুল তো জাপানি প্রযুক্তিতেই তৈরি হয়েছে৷ তাছাড়া দেশের প্রথম মেট্রোরেল তৈরির সময়েও জাপান থেকে কোচ আনা হয়েছিল৷ মুম্বই-‌আহমেদাবাদের পর কলকাতা-‌দিল্লি, কলকাতা-‌মুম্বইয়ের মতো যে রুটগুলি হবে, সেক্ষেত্রে ভারত অনেকটা এগিয়ে যাবে৷'‌'

‌জাপানে যে কৌশলে চালানো হয় বুলেট ট্রেন, ভারতে ঠিক সেই কৌশলেই তা চলবে না৷ এ কারণে বিমান আরও বেশি উচ্চতায় উঠে যেতে পারে তরতরিয়ে, কিছুটা সেই কৌশলেই বুলেট ট্রেন ছুটবে ভারতে৷ পদ্ধতির নাম ‘‌ম্যাগলেভ'৷ সেটা কী জিনিস? জাপান‌সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বুলেট ট্রেন চলে যে কৌশলে, বিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকে বলে ‘ম্যাগনেটিক লেভিটেশন'৷ সংক্ষেপে, ‘ম্যাগলেভ'৷ কোনও কিছু ছুটছে মানে কোনও বাধা, কোনও প্রতিরোধকে ঠেলে এগোচ্ছে৷ সামনে এগোতে গেলেই বাধা কাটাতে হবে৷ কথাটা জীবনে যতটা সত্যি, ততটাই সত্যি প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষেত্রেও৷

এদিকে, একের পর এক দুর্ঘটনার জেরে সম্প্রতি রেলমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছে সুরেশ প্রভু এবং রেলবোর্ডের চেয়ারম্যান অরুণেন্দ্র কুমারকে৷ এরই মধ্যে নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে পাশে নিয়ে যেদিন বুলেট ট্রেনের কাজ শুরু করলেন প্রধানমন্ত্রী, ঘটনাচক্রে সেদিনই নয়াদিল্লি রেলস্টেশনে বেলাইন হলো জম্মু-নয়াদিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস!

এখানেই হাজার প্রশ্ন উঠছে৷ বিতর্কও হচ্ছে৷ তেমনি জমি অধিগ্রহণের আশঙ্কায় বিরোধিতাও এসেছে চাষিদের থেকে৷ মহারাষ্ট্রের পালঘর জেলার কৃষকরা জমি হারানোর ভয়ে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের বিরোধিতায় পথে নেমেছেন৷ কৃষিজমি হাতছাড়া হলে তাঁদের জীবনে সঙ্কট নেমে আসবে—এই যুক্তি দেখিয়ে বইসর রেল স্টেশনের বাইরে স্লোগান আর কালো পতাকা দেখিয়ে‌ছে তারা৷

অন্যদিকে, বুলেট ট্রেন নিয়ে বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে রাজনীতি করার অভিযোগ তুলেছে কংগ্রেস৷ কংগ্রেসের বক্তব্য, ‘‌‘‌গুজরাটে বিধানসভা নির্বাচনে ফায়দা তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রী জেনেবুঝে এই প্রকল্পটি দু-‌বছর আটকে রেখেছিলেন৷ এখন ভোটের মুখে ফায়দা তুলতেই জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে রোড-‌শো করে শিলান্যাস করছেন মোদী৷'‌'‌ রেলবোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অরুণেন্দ্র কুমারের সময়েই বুলেট ট্রেনের প্রকল্প গতি পেয়েছে৷ তিনি অবশ্য বলছেন, ‘‘‌এই প্রকল্পে শুধুমাত্র জমির প্রয়োজন হচ্ছে৷ ১ দশমিক ‌২ লক্ষ কোটি টাকার ৮৮ শতাংশই ঋণ দিচ্ছে জাপান৷ তা-‌ও বার্ষিক ০ দশমিক ১ শতাংশ সুদের হারে৷ ফলে এই চুক্তি কোনোভাবেই রেলের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে না৷ তাছাড়া রেলের সুরক্ষায় যথেষ্ট কাজ হচ্ছে৷''