রামকিঙ্করের চিত্রকর্ম
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩ভাস্কর্য শিল্পের এক বিখ্যাত নাম রামকিঙ্কর বেজ৷ তাঁর সৃষ্ট সাঁওতাল পরিবার বা কলের বাঁশি-র মতো ভাস্কর্যগুলির সঙ্গে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত৷ আজীবন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনেই সৃষ্টিতে মগ্ন রামকিঙ্কর নিজের কাজের স্থায়িত্ব সম্পর্কে আদৌ সচেতন ছিলেন না৷ অনেক সময় আর্থিক অস্বচ্ছলতাও হয়তো তার একটা কারণ, কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওই ভাস্কর্যগুলি সময়ের আঁচড়ের থেকে আগলে রাখাটাই শান্তিনিকেতনের কলাভবনের কাছে চিরকালের একটা গুরুদায়িত্ব৷
এর বাইরেও থেকে গিয়েছেন এক রামকিঙ্কর, যদিও সেটাও একই রকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে, তবে সেটা আত্মীয়, বন্ধু, ছাত্র-ছাত্রী এবং গুণমুগ্ধদের মধ্যে৷ কেউ হয়তো প্রিয় কিঙ্করদার একটা কাজ চেয়ে নিয়েছিলেন, কারও খাতায় রয়ে গিয়েছে মাস্টারমশাই রামকিঙ্করের হাতে আঁকা একখানি খসড়া অথবা কাউকে রামকিঙ্কর নিজে থেকে ভালবেসে উপহার দিয়েছিলেন নিজের আঁকা ছবি৷ মূলত শান্তিনিকেতনে এবং কলকাতায় ব্যক্তিগত সংগ্রহে রামকিঙ্করের আঁকা এরকম বেশ কিছু দুর্লভ ছবি নিয়ে প্রদর্শনী সাজিয়েছেন কিউরেটর দেবদত্ত গুপ্ত৷
দিল্লিতে ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট-এর উদ্যোগে রামকিঙ্করকে নিয়ে সর্বশেষ যে বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল, তার সঙ্গে কলকাতার প্রদর্শনীর এইটাই তফাৎ, বললেন দেবদত্ত যে, ন্যাশনাল গ্যালারির নিজের কাছে রয়েছে রামকিঙ্করের কাজের এক বিপুল সংগ্রহ৷ তা ছাড়া ওদের পরিকাঠামো, ব্যবস্থাপনা, সবই অনেক বেশি ভাল৷ সেই জায়গায় কলকাতার প্রদর্শনীতে থাকছে অনেক বেশি অন্তরঙ্গ রামকিঙ্কর৷
বিভিন্ন জনের সংগ্রহ থেকে ছবিগুলো সংগ্রহ করার সময় নানা টুকরো টুকরো গল্প এসে জমা হয়েছে কিউরেটর দেবদত্তর ঝুলিতে৷ যেমন, নন্দকিশোর মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিশ্বভারতীর আলোকচিত্রী, রামকিঙ্করেরও অনেক ছবি তাঁর তোলা৷ রামকিঙ্কর একবার নিজে তাঁর বাড়ি বয়ে এসে বলেছিলেন, ‘‘সবাই আমার ছবি চেয়ে নিয়ে যায়, তুই তো কখনও কিছু নিস না৷ এই নে, তোর জন্যে একটা ছবি এনেছি৷''
মানুষ রামকিঙ্কর এবং সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতোই নির্মোহ এক শিল্পীর আদলটাও ধরা দেয় এই সব গল্প থেকে৷ কিছু উজ্জ্বল উদ্ধারও আছে এই প্রদর্শনীতে৷ যেমন রামকিঙ্করের আঁকা একটি তেল রঙের ছবি এর আগে কেবল দুভাবে দেখা গিয়েছে৷ চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে এবং আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষের তোলা একটি ফটোগ্রাফে৷ লাঞ্চ নামে ১৯৪১ সালে আঁকা এই ছবিটি প্রথমবার সামনাসামনি দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে এই প্রদর্শনীতে৷
এছাড়াও, কলাভবনের কিউরেটর সুশোভন অধিকারীর উদ্যোগে এবং সক্রিয় সাহায্যে পাওয়া গিয়েছে অমূল্য কিছু নোটবই, যার একটিতে চুনার-এর এক পাথর ব্যবসায়ীর নাম-ঠিকানা লিখে রেখেছেন রামকিঙ্কর এবং কীভাবে, কোন ট্রেনে চুনার যাওয়া যাবে, তারও নোট নেওয়া আছে৷ এটা ঐতিহাসিক কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ দিল্লিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সদর ফটকের দুপাশে যে যক্ষ এবং যক্ষীর অতিকায় ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন রামকিঙ্কর, তার পাথর চুনার থেকেই এসেছিল৷
ওই নোটবুকে যক্ষ ও যক্ষীর একটা খসড়াও পাওয়া গিয়েছে৷ পাওয়া গিয়েছে বিখ্যাত কলের বাঁশি-র লে আউট৷ আরও একটি অসাধারণ টেরাকোটার ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে মাছমুখে বিড়ালের, যা অবধারিতভাবে কালীঘাটের পটের কথা মনে করায়৷ প্রতি বছর শান্তিনিকেতন কলাভবনের আগ্রহে যে নন্দনমেলা হয়, সেই মেলার দ্বিতীয় বছরে এই টেরাকোটার কাজটি রামকিঙ্কর করেছিলেন৷ একটি লোকের পিঠ চুলকানোর মজার এক টেরাকোটার কাজও দেখা যাবে৷
দেবদত্ত গুপ্ত এর আগে দুই বিখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারীর দুটি প্রদর্শনী কিউরেট করেছিলেন৷ বলছিলেন, আচার্য নন্দলাল বসুর ক্ষেত্রে তাঁর দুই কন্যা গৌরী ভঞ্জ এবং যমুনা সেনের থেকেই অধিকাংশ ছবি পাওয়া গিয়েছিল৷ রামকিঙ্করের প্রদর্শনীর জন্য একটু বেশি খুঁজতে হয়েছে, বেশি ঘুরতে হয়েছে৷ কিন্তু তাঁর কাজ অনেকটাই সহজ করে দিয়েছেন বিশ্বভারতী কলাভবনের কিউরেটর সুশোভন অধিকারী৷ রামকিঙ্করকে চিনতেন, কলকাতা এবং শান্তিনিকেতনের এমন অনেকেই অকুণ্ঠ সাহায্য করেছেন, যা না পেলে হয়তো এই প্রদর্শনী হতো না, বললেন দেবদত্ত৷
ভাস্কর রামকিঙ্কর বেজের আঁকা ছবির এই দুর্লভ সংগ্রহ দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে ২রা নভেম্বর পর্যন্ত৷