ব্যাংক জালিয়াতি ফুলে ফেঁপে উঠছে ভারতে
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকে ১১,৪০০ কোটি এবং রোটোম্যাক কর্তার ৪ হাজার কোটি টাকার জলিয়াতি নাকি হিমশৈলের চূড়ামাত্র! পিএনবি কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার জানিয়েছে, জালিয়াতির পরিমাণ আরও ১,৩২৩ কোটি টাকা বেশি হতে পারে৷ ফলে এই দুর্নীতির শিকড় যে অনেক গভীরে তা বলাই বাহুল্য৷
নীরব মোদী-কাণ্ড সামনে আসতেই চোঠের সামনে ভেসে উঠছে আরও একগুচ্ছ তালিকা৷ গুজরাটের সানন্দে ন্যানো কারখানার জন্য টাটাদের ৩৩ হাজার কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়া৷ গুজরাটেই আদানিদের ১৬ হাজার একর জমি, প্রতি বর্গমিটার ১ টাকা ৩০ পয়সা দামে দেওয়া (বাজার দর ১১০০ টাকা)৷ ওই গুজরাটেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন প্যাটেলের নিকটাত্মীয়কে ৪২২ একর জমি, ৯২ শতাংশ কম দামে৷ মহারাষ্ট্রে চিক্কি কেলেঙ্কারি৷ পঙ্কজা মুন্ডের সৌজন্যে বেশি দামে বাদামের তক্তি কেনা, ক্ষতি ৭০০ কোটি টাকা৷ রাজস্থানে খনি কেলেঙ্কারি৷ আনুমানিক ক্ষতি ৪৫ হাজার কোটি৷ মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম কেলেঙ্কারি৷ ছত্তিশগড়ে রেশন কেলেঙ্কারি, ক্ষতি ৩৬ হাজার কোটি টাকা ইত্যাদি৷
সামনে এসেছে রাফাল চুক্তির তথ্যও৷ একটি বিমানের দাম ছিল ৫০০ কোটি টাকা, ছিল প্রযুক্তি বিনিময়ের চুক্তি, হ্যাল তৈরি করতে পারত৷ প্রধানমন্ত্রী প্যারিস গেলেন৷ তারপর ফ্রান্স থেকে রাফাল বিমান কেনার নতুন চুক্তিতে দাম দাঁড়াল ১৬৪০ কোটি৷ বিমান কিনতে খরচ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা৷ এরপর ১১,৪০০ কোটির ব্যাংক কেলেঙ্কারি৷ নীরব মোদী ও তাঁর মামা মেহুল চোকসি ভারত ছেড়ে পগার পার৷ মোদী জমানাতেই ব্যাংককে ৯০০০ কোটি টাকা ফাঁকি উড়ে গেছেন বিজয় মালিয়া৷ ললিত মোদী ফেরৎ আসেননি৷ তিনি হজম করেছেন ৪৬৮০ কোটি৷ এই তিনজনই গায়েব করেছেন ২৫ হাজার কোটি৷ প্রাথমিক হিসেব, ব্যাংক থেকে এভাবেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকা৷
কয়েক দশক ধরে রাজধানী দিল্লিতে কর্মরত প্রবীন সাংবাদিক শরদ গুপ্তার কথায়, ‘‘নরেন্দ্র মোদী নিজেকে দেশের চৌকিদার বলে দাবি করতেন৷ বলতেন, ‘দেশের অর্থ বিদেশে যেতে দেবো না৷' এখন যখন একের পর এর আর্থিক দুর্নীতি হচ্ছে, তখন তিনি চোখ বন্ধ করে রেখেছেন৷ নীরব মোদী, রোটোম্যাকের কোঠারি সিবিআই-এর ২০১৭-১৮ সালে মোট সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা নীরব মোদীকে ঋণ দিয়েছে পিএনবি৷ অর্থাৎ এনডিএ আমলেই৷ এরপরও মোদীজি ও তাঁর দল দাবি করছে, এই সব দুর্নীতি বিরোধীদের পাপ! তাহলে উনি কার এবং কীসের চৌকিদার? এছাড়াও শেষতম দুর্নীতিতে দেখা যাচ্ছে, নীরব মোদীর ছোট ভাই মুকেশ আম্বানির বোনের জামাই৷ রোটোম্যাক কর্তা (৪ হাজার কোটির দুর্নীতি) বিক্রম কোঠারির ছেলে আবার গৌতম আদানির ভাইয়ের জামাই৷ গোটা বিশ্ব জানে, আম্বানি ও আদানি নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ৷ এর অর্থ হলো, দুর্নীতিগ্রস্তরা মোদী ঘনিষ্ঠ৷ অন্যদিকে, দু'মাস পরেই কর্ণাটকের নির্বাচন৷ বলা যেতে পারে, বিরোধীদের হাতে শক্ত হাতিয়ার আছে৷ এখন দেখার, বিরোধী শিবির সেই হাতিয়ার দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে কিনা৷''
এর আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের তরফে বলা হয়, অবৈধভাবে ১১,৪০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল হীরে ব্যবসায়ী নীরব মোদী ও তাঁর কোম্পানি৷ এই নিয়ে ধরপাকড় শুরু হয়৷ গ্রেপ্তার করা হয় পিএনবি-র কয়েকজন আধিকারিককে৷ এরপর নীরব মোদীর কোম্পানির অধিকারিক তথা দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পপতি মুকেশ আম্বানির খুড়তুতো ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছে, ললিত মোদী থেকে বিজয় মালিয়া এবং সর্বশেষ নীরব মোদী৷ পর পর আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে গত চার বছরে৷ অপরাধীরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন৷ মোদী সরকার কী করেছে?
৫ মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্ব৷ ওই অধিবেশনে নীরব ও পিএনবি কেলেঙ্কারি নিয়ে সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর জবাব চেয়ে এক জোট বিরোধী শিবির যে সরব হবে, তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছে বিজেপি৷ এই আক্রমণের মোকাবিলা কীভাবে করা যায়, সেই কৌশল তৈরিতেই এখন মরিয়া শাসক দল৷
আসা যাক বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর কথায়৷ ছেলে জয় শাহর ব্যবসা এক লাফে বাড়ল কীভাবে? তা নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন তুলছে বিরোধীরা৷ তবে সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে কংগ্রেসকে পালটা খোঁচা দেওয়ার পথেই বেশি সাচ্ছন্দ বোধ করছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ৷ তাঁর টার্গেট পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিং৷ নীরব মোদী, বিক্রম কোঠারি কাণ্ডে বিরোধীদের আক্রমণে জেরবার বিজেপির সামনে অস্ত্র হিসেবে উঠে এসেছে ব্যাংক প্রতারণায় অমরেন্দ্রর পরিবারের জড়িয়ে থাকার অভিযোগ৷ আর একে সামনে রেখেই সোমবার কংগ্রেসকে নিশানা করেছে বিজেপি৷
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী মনে করেন, একের পর এক দুর্নীতি ফাঁস হওয়ায় বিজেপি এবং মোদী সরকার সিঁদুরে মেঘ দেখছে৷ কিন্তু বিরোধী দলগুলির মধ্যে একতা এখনও নেই৷ ভবিষ্যতে এর সুবিধা নিতে পারে বিজেপি৷ কারণ হিসেবে তিনি পিএনবি-কাণ্ডে সংসদে ‘যুগ্ম সংসদীয় কমিটি' গঠন নিয়ে কংগ্রেস ও তৃণমূলের মতানৈক্যের কথা বলেন৷ বলেন, ‘‘বাংলায় সারদা, নারদ ইত্যাদি তদন্তে সিবিআই এক ইঞ্চিও নড়ছে না৷ অন্যদিকে, গত এক মাসে মমতা ব্যানার্জি সরাসরি নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণ করছেন না৷ এটি রাজনৈতিক ইঙ্গিত ছাড়া আর কী হতে পারে!''
যদি কোনো ভারতবাসী ভেবে থাকেন নীরব মোদী-কাণ্ডে শুধুমাত্র ব্যাংক বা সরকারের ক্ষতি হয়েছে, তাহলে বড্ড ভুল হবে৷ সাধারণ নাগরিকের ওপর এই দুর্নীতির প্রভাব কীভাবে পড়তে পারে?
প্রথমত, এতবড় দুর্নীতির পর সাধারণের করের টাকা ব্যাংকে চলে যাবে৷ দেশের সাধারণ মানুষের করের টাকা ব্যাংকগুলিকে ‘রি-ক্যাপিটালাইজ' করার কাজে ব্যবহার করবে সরকার৷ গত বছর প্রায় ২ দশমিক ১১ লক্ষ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলিকে রি-ক্যাপিটালাইজ করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে৷
দ্বিতীয়ত, আম জনতার পকেটে টান পড়বে৷ পিএনবি-র এই দুর্নীতি সামনে আসার পর ব্যাংকের শেয়ার মূল্য হু গু করে নেমেছে৷ ১৪ ফেব্রুয়ারির পর থেকে ৬০ শতাংশ মূল্য কমেছে৷ শুধু পিএনবি নয়, অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শেয়ার মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে৷ এতে একাধারে ব্যাংক নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষও৷
এবং তৃতীয়ত, তাছাড়া ব্যাংকঋণ পাওয়া আরও কষ্টসাধ্য হবে৷ গত ৯ মাসে পিএনবি যা রোজগার করেছে, তার ১০ গুণ টাকা ক্ষতি হয়েছে ব্যাংকের৷ ব্যাংকের মূলধনে টান পড়েছে৷ তাই নতুন করে ঋণ দেওয়া ব্যাংকের পক্ষে আর সম্ভব হবে না, যা পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষের ক্ষতি৷
‘‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা'' বলেছিলেন তিনি, নরেন্দ্র মোদী৷ বলেছিলেন, ‘‘আমাকে আপনারা দায়িত্ব দিন, দেশের চৌকিদার হিসেবে কাজ করব৷'' এই মন্তব্যও মোদীরই৷ বিরোধী দলগুলি প্রশ্ন তুলেছে, চৌকিদার কি তবে লুঠের অংশীদার হয়ে গেলেন? এতকিছুর পরেও সংকীর্ণ স্বার্থে দলাদলি করে আসলে বিজেপিকেই মদত দিতে পারে কয়েকটি বিরোধী দল৷ কিন্তু কংগ্রেসের মতো প্রদান বিরোধীরা ময়দানে নেমে পড়েছে৷ তাদের বক্তব্য, ২০১৯ সালে মোদীর বিদায় অনিবার্য৷