বেয়াইকে ফাঁসাতে শিশু হত্যা!
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২সর্বশেষ গত শুক্রবার বরিশালে ইয়াসিন নামে একটি নয় বছরের শিশুকে হত্যা করেছে তার এক আত্মীয়৷ ছেলের শ্বশুরকে ফাঁসাতে এই শিশুটিকে নির্মমভাবে হত্যা করে সিরাজুল ইসলাম৷ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে৷ আদালতে তিনি হত্যার কথা স্বীকার করেছেন৷ এর আগেও এমন অসংখ্য ঘটনায় শিশুদের হত্যা করা হয়েছে৷
শিশুদের প্রতি হঠাৎই নির্মমতা বেড়ে গেছে? নাকি আগে থেকেই শিশু হত্যার এমন ধারা প্রচলিত ছিল? জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে কিছু যে বেড়েছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই৷ তবে মিডিয়ার কারণে এই খবরগুলো এখন আর গোপন থাকে না৷ আগে অনেক খবরই আমরা জানতে পারতাম না৷ তবে কোন কিছুই তো বিচ্ছিন্ন নয়,আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একটা অস্থিরতা আছে৷ সামাজিক অবক্ষয় হচ্ছে, সেটারই প্রতিফলন এসব ঘটনায় পাওয়া যাচ্ছে৷’’
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজের সর্বস্তরেই শিশুরা প্রতিহিংসার বলি হচ্ছে৷ পারিবারিক, সামাজিক সচেতনতার অভাব, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, পর্নোগ্রাফি, মানসিক অস্থিরতা, অনৈতিক সম্পর্কের কুপ্রভাব, মাদকাসক্তি, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, মানসিক অসুস্থতার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা বাড়ছে৷ পারিবারিক অশান্তির কারণে অনেক মা-বাবা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ এরপর জীবন ও সন্তানের মায়া ত্যাগ করে তারা নিষ্ঠুর আচরণ করেন৷
শিশু ইয়াসিনকে যে কারণে হত্যা করা হয়েছে
বরগুনা সদর উপজেলার ফুলঝুড়ি গ্রামের মো. সগীরের ছেলে ইয়াসিন৷ সিএনজি অটোরিকশা চালক সগীর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন৷ ইয়াসিনের মা প্রবাসী৷ ইয়াসিন তার দাদি শিরিন বেগমের সঙ্গে থাকত গ্রামে৷ দাদির সঙ্গে সে গত ৩১ জানুয়ারি বরিশাল নগরীর রূপাতলী উকিল বাড়ি সড়কে দাদির বোন আলেয়া বেগমের বাসায় বেড়াতে যায়৷ সিরাজুল আলেয়ার স্বামী৷
বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) লোকমান হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সিরাজুলের ছেলে আল আমিন আট মাস আগে একই এলাকায় বিয়ে করে৷ তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চলছে৷ এরই জেরে আল আমিনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করেন তার শ্বশুর৷ ছেলেকে মামলা থেকে বাঁচাতে নানান ফন্দি খুঁজছিল সিরাজুল৷ বেড়াতে আসা ইয়াসিনকে শুক্রবার লাকড়ি সংগ্রহের কথা বলে বেতার স্টেশন সংলগ্ন আবাসিক এলাকায় নিয়ে যায়৷ সেখানে একটি পরিত্যক্ত টয়লেটে তাকে হত্যা করে বাড়িতে ফেরে সিরাজুল৷ পরে অন্যদের সঙ্গে সিরাজুলও ইয়াসিনকে খোঁজাখুঁজির অভিনয় করে এবং এলাকায় মাইকিং করায়৷ পরদিন সকালে স্থানীয়রা লাশ দেখতে পেলে সিরাজুল ঘটনাস্থলে যায় এবং হত্যাকাণ্ডের জন্য আল আমিনের শ্বশুরের পরিবারকে দায়ী করতে থাকে৷ এতেই তার প্রতি পুলিশের সন্দেহ বাড়ে৷ পরে সিসিটিভির ফুটেজ ও একটি ছোট্ট শিশুর জবানিতে মেলে সর্বশেষ ইয়াসিন সিরাজুলের সঙ্গেই ছিল৷ জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সিরাজুল হত্যার কথা স্বীকার করেছেন৷ পরে তিনি আদালতে জবানবন্দিও দেন৷’’
এই ঘটনায় সিরাজুলের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন মো. সগীর৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি হত্যাকারীর ফাঁসি চাই৷ তাদের আত্মীয় বলে পরিচয় দিতে চাই না৷ আজকেই আমার ছেলেটার মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার কথা ছিল৷ অথচ ওর লাশ দাফন করে এলাম৷ এমনভাবে যেন আর কারও সন্তানকে জীবন দিতে না হয়৷’’
শিশু হত্যার কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা
গত ৫ এপ্রিল খুলনায় তানিশা আক্তার নামে পাঁচ বছর বয়সি একটি ঘুমন্ত শিশুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ রাত ১০টার দিকে তেরখাদা উপজেলার আড়কান্দী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে৷ এ ঘটনায় পুলিশ শিশুটির সৎ মা মুক্তা খাতুনকে আটক করে৷
গত ৪ এপ্রিল নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার নজরপুর গ্রামের নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার চারদিন পর এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ৷ শিশুটির নাম মিজানুর রহমান ওরফে আশরাফুল (৬)৷ পরে পুলিশ মাটিতে অর্ধেক পুঁতে রাখা অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করে৷
গত ১৬ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল সদর ইউনিয়নের নোয়াহাটি গ্রাম থেকে আট বছর বয়সি এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ৷ পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, শিশুটির কানে থাকা দুই আনার স্বর্ণের দুল নিতেই তাকে হত্যা করা হয়েছে৷ নিহত শিশুটির নাম কাশফিয়া আক্তার (৮)৷ সে নোয়াহাটি গ্রামের আবদুল কাদেরের মেয়ে৷
১৩ মার্চ গাজীপুর সদরের বানিয়ারচালা এলাকায় একটি বাসার সেপটিক ট্যাংক থেকে তিন বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার হয়েছে৷ শিশুটির নাম শান্ত৷ সে ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানার উত্তর নয়নপাড়া এলাকার বাসিন্দা সাদেক মিয়ার ছেলে৷
এর আগে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানার পুলিশ টয়লেট থেকে নূর-হাওয়া নামে চার মাস বয়সের একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করে৷ এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে শিশুটির মা তানজি বেগমকে (৩৮) আটক করে পুলিশ৷
পরিসংখ্যানে শিশু হত্যা
এমন অসংখ্য শিশু মৃত্যুর ঘটনা গেল বছর ঘটেছে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে গত বছর যে ৫৯৬ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে তার মধ্যে ৬ বছরের কম বয়সি শিশু ১৪০ জন, ৭ থেকে ১২ বছর বয়সি শিশু ১৩৪ জন, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সি শিশু ২৬৩ জন এবং ৫৯ জন শিশুর বয়স সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়নি৷
শিশু অধিকার ফোরাম ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে মারা গেছে ১৪৫ শিশু৷ ২০১৯ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ২৬৬ জন শিশু, ২০১৮ সালে ২২৭ জন, ২০১৭ সালে বিভিন্নভাবে হত্যার শিকার হয় ৩৩৯ জন শিশু, ২০১৬ সালে হত্যার শিকার হয়েছে ২৬৫, ২০১৫ সালে ২৯২, ২০১৪ সালে ৩৬৬, ২০১৩ সালে ২১৮ ও ২০১২ সালে ২০৯ জন৷ এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যাচ্ছে শিশু হত্যার হার কী পরিমাণ বেড়েছে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিশুমৃত্যুর এই সংখ্যাগুলো উদ্বেগের৷ কিন্তু আগের আমরা সংখ্যা জানতে পারতাম না, ফলে মৃত্যু অনেক কম মনে হতো৷ এখন আমরা বেশি জানতে পারছি৷ সামাজিক অবক্ষয় থেকেই এই অপরাধগুলো ঘটছে৷ এর জন্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও অনেকখানি দায়ী৷ সব মিলিয়ে আমাদের এখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে৷”
সমাজবিজ্ঞানী নেহাল করিম মনে করেন, ‘‘শিশুদের হত্যা করে কাউকে ফাঁসানো সহজ৷ যে কারণে অপরাধীরা এই সুযোগটা নিয়ে নেয়৷ চারটা চকলেট দিয়ে একটা শিশুকে বাড়ি থেকে বাইরে নেওয়া যায়৷ কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষকে কোথাও নিতে ৪-৫ জন বলশালী লোক ভাড়া করতে হয়৷ এই কারণে অপরাধীরা এই সুযোগটা নেয়৷’’
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের ছবিঘরটি দেখুন...