ঘাটতি, ব্যর্থতা
২১ এপ্রিল ২০১৩বেসরকারি চ্যানেলগুলো আসার পর থেকে বিটিভির দৈন্য আরো বেশি করে চোখে পড়তে থাকে৷ দিনে দিনে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বাধ্য না হলে রাষ্ট্রীয় চ্যানেলটি কেউ বোধহয় আর দেখেন না৷ বেসরকারি চ্যানেলগুলেই দেখছেন সবাই, কিন্তু সেখানেই বা কী দেখছেন? সেখানেও কি প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে? এটিএন নিউজের নিউজ অ্যান্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-এর এডিটর প্রভাষ আমিন টেলিফোন সাক্ষাৎকারের শুরুতেই স্বীকার করেছেন দর্শকের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মাঝে এখনো যথেষ্ট ফারাক৷ দক্ষ কর্মীর অভাব, অর্থাভাব, চ্যানেল যে হারে বেড়েছে সেই অনুপাতে বিজ্ঞাপনের বাজারের বিস্তৃতি না ঘটায় চ্যানেলগুলোর অতি আপোশকামী অবস্থান নিতে বাধ্য হওয়া – কারণ হিসেবে এসবেরই উল্লেখ করেছেন প্রভাষ৷
দু-একটি সমস্যার বর্ণনায় উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র৷ প্রচার এবং গ্ল্যামারের আকর্ষণে অনেকেই আসছেন এ পেশায়, এসে কাজটা বুঝে ওঠার আগেই নেমে পড়ছেন প্রতিযোগিতার ময়দানে৷ বিষয় বোঝেন না, প্রশ্ন করতেও শেখেননি এমন তরুণও বিশিষ্ট জনদের গিয়ে বলছেন, ‘‘একটা কিছু বলুন'', না বললে সেদিনের খবরে যে তাঁর কোনো প্রতিবেদন যাবেনা! একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক না বললে টিভি পর্দায় ভেসে ওঠা অনেক প্রতিবেদনের পেছনের এই গল্পটা অনেকে হয়ত বিশ্বাসই করতেন না৷
প্রশিক্ষণ ছাড়াই নেমে পড়া এমন আনকোরারা যেমন কিছু একটা করে দেখানোর তাগিদ থেকে সাংবাদিকতাকে খেলো করছেন, কখনো কখনো তার চেয়েও বড় সমস্যা তৈরি করছেন প্রশিক্ষণ এবং অনেকের কাছে তারকা মর্যাদা পাওয়া অভিজ্ঞরাও৷ বিটিভির ব্যাপারে প্রভাষের সাম্প্রতিক ক্ষোভের কারণ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠানও বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে সম্প্রচার করা৷ তাঁর ধারণা ছিল, দীর্ঘ প্রায় ৪৯ বছরের নিয়ম ভেঙে বিটিভিকে এমনটি করতে হয়েছে কর্তাব্যক্তিরা সময় মতো সিদ্ধান্ত নিতে না পারায়৷ গত ১৫ এপ্রিল প্রচারিত এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন ব্যাপারটি ঘটেছিল কারিগরি সমস্যার কারণে৷ সেখানে বিটিভিকে আগামী এক বছরের মধ্যে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন তিনি৷
বিটিভির সিদ্ধান্ত নেয়ায় জটিলতা বা অক্ষমতার বিপরীতে বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে কি জাতীয় সংকট বা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তেও সিদ্ধান্ত নেয়া অতি সহজ? বেসরকারি চ্যানেলের কোনো কোনো ‘তারকা প্রতিবেদক'ও অতীতে দেশের জন্য খুব স্মরণীয় সংকটের মুহূর্তেও যথাযথ দায়িত্ববোধের পরিচয় রাখতে পারেননি – এ কথা মনে করানোর পর প্রভাষ জানালেন, তিনি মনে করেন সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের দক্ষতার অভাব এবং অগভীর পর্যবেক্ষন ক্ষমতার পাশাপাশি চ্যানেল কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও সেখানে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে৷
সুতরাং বেসরকারি টিভি চ্যানেল বেড়েছে কিন্তু সেই অনুপাতে দক্ষ সাংবাদিক, কলাকুশলী আসেনি বলে যেমন অদক্ষ অপেশাদারিত্বের ছাপ থাকে, ‘দক্ষ' এবং ‘অভিজ্ঞ'দের ভুলের বোঝাও ছোট থেকে বড় হয় দিনে দিনে৷ সততা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে অনেকের বেলায়৷ সংখ্যায় এখনো হয়ত নগণ্য, তাই বলে বিষয়টি আর অগ্রাহ্য করার অবস্থায় নেই৷ অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধও ভূমিকা রাখে অপসাংবাদিকতায়৷ এসব নিয়ন্ত্রণের সহজ কোনো উপায় দেখছেন না প্রভাষ আমিন৷ সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের কথা স্বাভাবিক কারণেই তাঁর কল্পনার বাইরে৷ মনে করেন, সিনিয়র সাংবাদিকরা মিলে একটা প্যানেল করলে সেই প্যানেল হয়ত বলতে পারবে সাংবাদিকতটা কেমন হওয়া উচিত, কী কতটুকু করা যাবে আর কোথায় গিয়ে না থামলে সাংবাদিকতা আর সাংবাদিকতা থাকেনা৷ অনিয়ন্ত্রিত, স্বাধীনতার নামে যা খুশি তাই করে যাওয়ার দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘আমার দেশ'-এর কথাও তুলে ধরতে ভোলেননি৷ সাক্ষাৎকারটি আগে ধারণ করা না হলে হয়ত ‘প্রথম আলো'-তে গনজাগরণ মঞ্চ নিয়ে ছোট গল্প লিখে ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গটিও আসতো প্রভাষের কথায়৷
অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচার, তীব্র প্রতিযোগিতার কথা বলা হলেও বিশেষ প্রতিবেদন তৈরিতে তার কোনো প্রমান না মেলা, একঘেঁয়ে হাস্যকর টক-শোর ছড়াছড়ি, শিক্ষা ও সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের অভাব – এসব বিষয়ও তুলে আনলে দীর্ঘ এ সাক্ষাৎকার হয়ত অতি দীর্ঘ হয়ে যেত৷ সে কথা ভেবেই বেসরকারি চ্যানেলগুলো নিয়ে রাখা হয়েছে আরেকটি পর্ব, ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠিয়ে নেয়া প্রভাষ আমিনের সেই সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হবে সোমবার, অর্থাৎ আগামীকাল৷
সাক্ষাৎকার: আশীষ চক্রবর্ত্তী
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ