বিশ্বকাপকে ঘিরে জীবন বিপন্ন
১৭ অক্টোবর ২০১৩নেপালের অভিবাসী শ্রমিক বিদে মাজাকোটি উঁচু সুদে ঋণ নিয়ে কাতারে কাজ করতে গিয়েছিলেন৷ তাঁকে গ্যারেজে কাজ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০ ফিট উঁচু একটি ভবনের কাজে লাগানো হয়েছিল৷ সেখানে কাজ করা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং সে সময় ব্যবস্থাপক বলেছিলেন, সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের নয়৷ কোনো সময় পারিশ্রমিক পেতেন, কোনো সময় তাও দেয়া হতো না৷ ফলে ঋণ শোধ তো দূরের কথা, খাওয়া-পড়ার খরচও জুটত না তাঁর৷ নেপালে ফিরে মেয়ের অস্ত্রোপচারের জন্য ভিটে-বাড়ি ও জমি বিক্রি করতে হয়েছে মাজাকোটিকে৷ এখন তিনি নিঃস্ব৷ ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন বা আইটিইউসি-র সমর্থিত ইকুয়াল টাইমসকে এসব কথা জানিয়েছেন কাতার ফেরত নেপালি শ্রমিক মাজাকোটি৷
মাজাকোটি একা নন, দক্ষিণ এশিয়ার এমন হাজারো শ্রমিকের সাথে একই ঘটনা ঘটেছে৷ যাঁরা প্রতি বছর উন্নত জীবনের আশায় মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান৷ কিন্তু সেখানে গিয়ে খারাপ আবাসন সমস্যা, চিকিৎসার অভাব, আইনগত সুবিধা এবং অর্থের অভাবের মুখোমুখি হতে হয় তাঁদের৷
একবিংশ শতাব্দীতে দাসত্ব
আইটিইউসি-র মতে, ১২ লাখ অভিবাসী শ্রমিক কাতারে নির্যাতন ও শোষণের শিকার হচ্ছেন, যাকে তারা একবিংশ শতাব্দীর দাসপ্রথা হিসেবে উল্লেখ করেছে৷ নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ থেকে আসা এসব শ্রমিক গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতেও ভয় পান, পাছে তাঁদের দেশে ফিরিয়ে দেয়া হয়, কিংবা চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়৷
বেশিরভাগ শ্রমিক দরিদ্রতা, কর্মসংস্থানের অভাবের জন্য নিজের সম্পদ বিক্রি করে বেশি অর্থ উপার্জনের আশায় মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেন৷ বেশিরভাগ সময় দেখা যায় যে, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, সেগুলো তারা পালন করে না৷ এমনকি বেশিরভাগ সময় এসব সংস্থা অবৈধ কাগজপত্র তৈরি করে এঁদের অবৈধভাবে বিদেশে পাঠায়৷ এশিয়া ফাউন্ডেশনের নন্দিতা বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ঋণের চাপ এবং অবৈধ প্রবেশের কারণে বেশিরভাগ সময় অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য হন এসব শ্রমিক৷
আইটিইউসি-র মহাসচিব শারান বুরো বলেছেন, বেশিরভাগ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এসব শ্রমিকরা একই জায়গায় গাদাগাদি করে থাকেন, যেখানে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই৷
কাফেলা ব্যবস্থা
রাষ্ট্র পরিচালিত কাফেলা বা স্পন্সর ব্যবস্থায় এই শোষণের মাত্রা আরো প্রতিফলিত হয়৷ এর মাধ্যমে শ্রমিকদের তাঁদের কাজ পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়, এমনকি ‘ওয়ার্ক পারমিট' ছাড়াই কাজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাতারের শ্রম আইন মেনে কর্তৃপক্ষ কোনো কাজই করে না৷
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাতারে শ্রম পরিদর্শক রয়েছেন মাত্র ১৫০ জন এবং তাঁদের পরিদর্শনে শ্রমিকদের সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত নয়৷ এসব অভিযোগের ব্যাপারে ডয়চে ভেলে কাতারের শ্রমমন্ত্রীর কাছে কিছু প্রশ্ন করলে তিনি কোনো উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান৷
ফিফা এ বিষয়ে সতর্ক
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে, কাতারে গ্রীষ্মে ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে ৪৪ জন নেপালি শ্রমিক নিহত হয়েছেন৷ নেপাল দূতাবাস জানিয়েছে, গত বছর আরব আমিরাতে ১৫১ জন নেপালি শ্রমিক নিহত হন৷ যাঁদের মধ্যে ৮৫ জন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে মারা যান৷
এই রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় কাতার কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, যেসব অভিযোগ উঠেছে তা তদন্ত করতে কমিশন গঠন করা হবে এবং তারা শ্রম পরিদর্শকের সংখ্যা দ্বিগুন করবে৷ তবে নেপালি শ্রমিকদের সাথে দাসদের মতো আচরণ করা হতো – এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তাঁরা৷
এদিকে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে যে, গণমাধ্যমের এসব প্রতিবেদনের দিকে লক্ষ্য রাখছেন তারা৷ বিশ্বকাপ নির্মাণ কাজ প্রকল্পে খারাপ কর্ম পরিবেশ এবং শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে তারা কাতার কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করবে৷
শ্রম ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন
যদিও গণমাধ্যমের এসব প্রতিবেদনের কারণে দোহা চাপের মুখে রয়েছে৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রতিবেদন কাতার কর্তৃপক্ষের আচরণে কোনো পরিবর্তন আনবে না৷ কেননা একই চিত্র সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত আর কুয়েতেও বর্তমান৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনের মনোন্নয়নের জন্য শ্রম ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার৷ বিশেষ করে, বিশ্বকাপকে সামনে রেখে নির্মাণ কাজের জন্য যেখানে আগামী বছরগুলোতে কয়েক লাখ শ্রমিক আনার পরিকল্পনা করছে কাতার, সেখানে এ অবস্থান উন্নতি প্রয়োজন বলে মনে করছেন তাঁরা৷ নন্দিতা বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে জানান, যেসব দেশ বিশ্বকাপে অংশ নেবে সেসব দেশ যদি কাতার কর্তৃপক্ষকে চাপ প্রয়োগ করে, একমাত্র তবেই এ অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে৷