বিভীষিকাময় একুশ আগস্ট
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়৷ ২০১৮ সালে এই মামলার রায়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত৷
নৃশংস হামলা
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য চলাকালেই চালানো হয় হামলা৷ নেতা-কর্মীদের রক্তে ভেসে যায় চত্বর, মানববর্ম তৈরি করে রক্ষা করা হয় শেখ হাসিনাকে৷ প্রাণে বাঁচলেও, শ্রবণশক্তি চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁর৷ ওই হামলায় মহিলা লীগ সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন; আহত হন কয়েকশ’ নেতা-কর্মী৷
দেশজুড়ে বিক্ষোভ
আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে পুরো দেশ৷ বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বেরিয়ে আসেন রাস্তায়৷ দেশজুড়ে তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়, আগুন দেওয়া হয় অনেক জায়গায়৷
বহুল প্রতিক্ষীত রায়
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ইতিহাসের ভয়াবহ এই হামলার রায় দেয় বিচারিক আদালত। ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়। ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয় আরও ১১ জনের।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর ফাঁসি
এই হামলায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে৷ হামলা পরিকল্পনায় ছিলেন ওই সরকারের উপমন্ত্রী, বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু৷ এই দু’জনসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত৷
তারেকের যাবজ্জীবন
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান এই হামলা পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন সরাসরি অংশ নেওয়া জঙ্গি গোষ্ঠী হুজি’র নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান৷ রায়ে তারেক ছাড়াও খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত৷
দণ্ডিত কর্মকর্তারা
রায়ের সময় আসামিদের মধ্যে ৩১ জন কারাগারে ছিলেন৷ ১৮ জন পলাতক ছিলেন। পরে দণ্ডিত দুই পুলিশ কর্মকর্তা আদালতে আত্মসমর্পণ করায় ১৬ জন থাকেন পলাতক। এর মধ্যে এক দশক ধরেই যুক্তরাজ্যে রয়েছেন তারেক রহমান। তাকে ফেরত আনতে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। বাকি পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছেন হারিছ চৌধুরী, মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার ও অন্যরা৷
মুফতি হান্নান
একুশ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাসহ জঙ্গি গোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদের ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যার পেছনে মূল ব্যক্তি হিসেবে দায়ী করা হয় মুফতি হান্নানকে৷ নাশকতা চালিয়ে হত্যার এক মামলায় ২০১৭ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে জবানবন্দিতে এই হামলার পেছনে তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবরসহ বিএনপি নেতাদের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছিলেন তিনি৷
আব্দুল কাহার আকন্দ
ঘটনার চার বছর পর তদন্তে হাত দিয়ে এই হামলার পেছনের ঘটনা তুলে আনেন সিআইডি কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ৷ তাঁর দেওয়া সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে গ্রেনেড হামলার পুরো ঘটনাই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল৷
জজ মিয়া
বিএনপি সরকারের আমলে এই হামলায় নোয়াখালীর নিরীহ যুবক মো. জালাল ওরফে জজ মিয়াকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয়৷ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁর কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়৷ পরে অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসে আসল কাহিনী৷
মামলার সবশেষ
১৬ বছর আগের এই ঘটনার বিচারিক আদালতের রায়ের পর মামলা দু’টি এখন আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে৷ এর আগে কারাগারে থাকা দণ্ডিত ব্যক্তিরা জেল আপিল করেছেন। আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদন ও আসামিদের আপিলের শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের বেঞ্চ নির্ধারণ করবেন৷
বিএনপির প্রতিক্রিয়া
এই মামলার রায়ের পর দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘‘এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নগ্ন প্রকাশ৷ আমরা এই ফরমায়েশি রায় প্রত্যাখ্যান করছি৷’’
ক্ষমতাসীনরা ‘সরাসরি জড়িত ছিল’
আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন এই ঘটনায় তখনকার ক্ষমতাসীনরা ‘সরাসরি জড়িত ছিল’ বলেই সংসদে আওয়ামী লীগকে কথা বলতেও ‘বাধা’ দিয়েছিল৷ বলেন, ‘‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মত একটি দল, যে দল দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, সেই দলের একটা সভায় এমন একটা গ্রেনেড হামলা, আর পার্লামেন্টে যিনি সংসদ নেতা, লিডার অফ দ্য হাউস, প্রধানমন্ত্রী, সে দাঁড়িয়ে বলে দিল- ‘উনাকে আবার কে মারবে’৷