বিদেশি পর্যবেক্ষক না আসা, সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায়
১০ ডিসেম্বর ২০১৮১৯৭৩ সালের নির্বাচনে নিশ্চিত করেই বলা যায় আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতো৷ জনগণের ভোটে পরাজিত খন্দকার মোশতাকের মতো দু-এক জনকে জেতানোর জন্যে, সেই নির্বাচনটিও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল৷
বাংলাদেশে জনগণের ভোটের প্রতিফলন দেখা যাওয়া শুরু হয় ১৯৯১ সালের নির্বাচন থেকে৷ তখন নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে৷ এখন আবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে৷ নির্বাচনটি কেমন হবে, কেমন হলো তা সরকারি দল একভাবে দেখবে৷ বিরোধী দল দেখবে তার দৃষ্টিকোণ থেকে৷ তৃতীয় একটি অবস্থান থেকে দেখবে পর্যবেক্ষকরা৷ এর মধ্যে দেশি পর্যবেক্ষক আছেন, আছেন বিদেশি পর্যবেক্ষক৷ বাংলাদেশের মতো দেশের জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বিদেশি পর্যবেক্ষক অপরিহার্য কিনা?
১. বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন এমন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে৷ এসব প্রতিষ্ঠানের বড় অংশটা এনজিও হিসেবে অন্যান্য কাজও করে৷ বাংলাদেশের রাজনীতি যেমন আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুইভাগে বিভক্ত, বিভক্ত পর্যবেক্ষকরাও৷ তাছাড়া এনজিও হিসেবে কাজ করায়, সরকার অসন্তুষ্ট হতে পারে এমন ঝুঁকি নিতে পারে না৷ নির্বাচন কমিশন সচিব ইতিমধ্যে তাদের হুমকি দিয়ে রেখেছেন ‘নিবন্ধন বাতিল' হয়ে যেতে পারে৷ পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রধান ব্যক্তিরা যেহেতু দলীয়ভাবে কথা বলেন, অনেকে সরকারের আনুকূল্য নিয়ে থাকেন, ফলে তাঁরা যা বলেন বা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের যে পর্যবেক্ষণ, তা খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায় না৷
২. দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, দেশি পর্যবেক্ষকদের বিষয়ে আস্থাহীনতা এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি অবিশ্বাসে, জনমন থেকে এই বিশ্বাস প্রায় উঠে গেছে যে নির্বাচন ‘সুষ্ঠু' হবে৷ এখানেই আসছে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের প্রসঙ্গ৷
বাংলাদেশের সাধারণ জনমানুষের ভেতরে, বিশেষ করে যাঁরা একটু সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করেন, তাঁরা নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক দেখতে চান৷ জনমনে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত যে, সরকার ধমক দিয়ে তাঁদের মুখ বন্ধ করতে পারবেন না৷ তাঁরা যা দেখবেন, তাই বলবেন৷ তাঁদের পর্যবেক্ষণে উঠে আসবে সঠিক চিত্র৷
৩. যখন জানা গেল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবারের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না, তখন যেন কিছুটা হতাশা তৈরি হলো৷ মানুষ মনে করে, দেশি পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন, গণমাধ্যমের সংবাদকে সরকার এখন খুব একটা গুরুত্ব দেয় না৷ যদিও শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম নির্বাচনের অনিয়ম-বিচ্যুতিগুলো মোটামুটি সঠিকভাবে পরিবেশন করে৷ গণমাধ্যমে প্রদর্শন করা সংবাদ মোকাবিলায় সরকার একটা অদ্ভুত নীতি অনুসরণ শুরু করেছে৷ ধরুন, কোনো একটি আসনে মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪০০৷ গণমাধ্যমে দেখানো হলো কেন্দ্র দখল-ব্যালট বাক্স ছিনতাই, জালভোট, মাস্তানির চিত্র৷ ৪০০টি কেন্দ্রের মধ্যে গণমাধ্যম হয়তো দেখালো ২০টি কেন্দ্রের চিত্র৷ তখন সরকার বলতে শুরু করে ৪০০টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ২০টিতে অনিয়ম হয়েছে, বাকি ৩৮০টি কেন্দ্রে নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে৷ নির্বাচন কমিশনও সরকারের এই যুক্তিটিই গ্রহণ করে৷ সরকার এবং নির্বাচন কমিশন বলতে শুরু করে, মাত্র ৫ শতাংশ কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে৷ বাকি ৯৫ শতাংশ কেন্দ্রে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে৷ এই ৯৫ শতাংশ কেন্দ্রের অনেকগুলোই যে অনিয়ম হওয়া ২০ শতাংশের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়, তা গণমাধ্যমে তেমন একটা প্রকাশিত হয় না৷ গোলযোগ হয় এমন কেন্দ্রের সংবাদই গণমাধ্যম জোর দিয়ে প্রচার করে৷ গোলযোগ ছাড়া যে কারচুপি হয়, তার সঠিক চিত্র উঠে আসে না গণমাধ্যমে৷
এখন টেলিভিশন টক শো'র বেশির ভাগ আলোচক-উপস্থাপক সরকার সমর্থক৷ ফলে যে টেলিভিশনে অনিয়মের সংবাদ প্রচার করা হয়, সেই টেলিভিশনের টক শো-তেই বলা হয় নির্বাচন ‘সুষ্ঠু' হয়েছে৷ দেশি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে সরকারের পক্ষাবলম্বনকারীরা প্রায় একই কথা বলেন৷ সরকারবিরোধী পর্যবেক্ষকরা কিছুটা ভয় নিয়ে কিছু কথা বলেন৷ তবে দলীয় পরিচয়ে পরিচিত হওয়ায়, তাদের কথা জনমনে গুরুত্ব পায় না৷ এবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর থাকায়, আদৌ কোনো কথা তাঁরা বলতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে৷ তাছাড়া নির্বাচন কমিশন বলে দিয়েছে ‘মূর্তির মতো' দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে৷ ছবি তোলা যাবে না, গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাও বলা যাবে না৷
৪. সঠিক চিত্র, অর্থাৎ ২০টি কেন্দ্রের বাইরের ৩৮০টি কেন্দ্রেরও অনেকগুলোতে যে অনিয়ম হয়েছে, তা বলে শুধু বিরোধী দল৷ স্বাভাবিকভাবেই সে কথা সরকারের কাছে বা নির্বাচন কমিশনের কাছে গুরুত্ব পায় না৷
বাস্তবতা হলো, ৪০০টি কেন্দ্রের প্রায় সব কটিতে অনিয়ম হয়৷ বিরোধী দলের এজেন্টদের সরকারি বাহিনী বের করে দেয়৷ নির্বাচনের আগের কয়েক দিন ধরপাকড় করে, আগের রাতে এজেন্টদের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেয়৷ নির্বাচনি কর্মকর্তারা সরকারের মনোভাব বুঝে কাজ করেন৷ এসব কথা গণমাধ্যম ছাড়া বলার বা দেখার আর কেউ থাকে না৷ বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি থাকলে তাঁরা হয়ত বলতেন, ‘জনমানুষের ধারণা এমনই৷'
৫. বিদেশি পর্যবেক্ষক, বিশেষ করে ইইউ কেন পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে না, তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা আছে৷ বাংলাদেশের সচেতন শ্রেণির ভেতরে ক্রমেই এই বিশ্বাসও তৈরি হচ্ছে যে, বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া বা না হওয়া নিয়ে পৃথিবীর কোনো দেশই চিন্তিত নয়৷ পর্যবেক্ষক পাঠালে সত্যটা বেরিয়ে আসতে পারে৷ তা হয়ত গুরুত্বপূর্ণ দেশের সরকারগুলোও চান না৷ কিছু কথা বলতে হয় বলে বলেন৷ তারাও বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে নিজের দেশের জন্যে কিছু পেতে চান৷
প্রশ্ন আসতে পারে, ধনী একটি দেশ বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশের থেকে কী চাইবে বা কী পাওয়ার আছে? সরলভাবে এমন প্রশ্ন সামনে আনলেও, উত্তর এত সরল নয়৷ উত্তর অ্যামেরিকার যে দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি করেছে, সরকারের বা নির্বাচনের দোষত্রুটি এখন তাদের কাছে আর অতটা বিবেচনার বিষয় নয়৷ আরেকটি দেশ খনিজ সম্পদ সেক্টরে বা এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের ব্যবসা করার সুযোগ পেয়ে খুশি৷ কেউ ই-পাসপোর্ট, কেউ স্যাটেলাইট, কেউ ট্রানজিট বা করিডোর, কেউ সেতুর কাজ, কেউ বিদ্যুৎ সেক্টরে ব্যবসার সুযোগ পেয়ে খুশি৷
বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু নির্বাচন কোনো দেশের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যু নয়৷ সুতরাং কারণ যা-ই বলা হোক, বিদেশি পর্যবেক্ষক না পাঠানোর মূল কারণ তা নয়৷ বাংলাদেশের নির্বাচনের সঠিক চিত্র জানার জন্যে বিদেশি পর্যবেক্ষকের প্রয়োজন আছে৷ বিদেশি পর্যবেক্ষক, বিশেষ করে ইইউ পর্যবেক্ষক না আসায় জনমনে কিছুটা হলেও হতাশা আছে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷