ভারতে বিদেশি পর্যটক ধর্ষণ
১১ জুন ২০১৩আয়ারল্যান্ড থেকে কলকাতায় এসেছিলেন ওই তরুণী, একটি এনজিও-র স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কাজ করতে৷ কাজের সূত্রে দার্জিলিং এবং আরও নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে হতো তাঁকে৷ কখনও কোনও বিপত্তি হয়নি৷ এক পরিচিতের মাধ্যমে কলকাতার এক যুবকের সঙ্গে আলাপ এবং বন্ধুত্ব হয়ে যায় ওই তরুণীর৷ সেদিন আবার ছিল মেয়েটির জন্মদিন৷ শহরেরই এক হোটেলে নিজের জন্মদিনের পার্টিতে পুরনো বন্ধুদের পাশাপাশি সদ্য আলাপ হওয়া ওই যুবকটিকেও আমন্ত্রণ জানান ওই তরুণী৷ অভিযোগ, সেই রাতে ওই জন্মদিনের পার্টি থেকে সারপ্রাইজ দেওয়ার নাম করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে, বা মতান্তরে মাঝরাস্তায় একটি গাড়ির ভিতরে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করে ওই যুবক৷ পর দিন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে পুলিশের কাছে গিয়ে ওই যুবকের নামে ধর্ষণের নালিশ জানান ওই তরুণী৷ যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়৷
মাত্র কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার পর, সম্প্রতি তার দুটি বিস্তারের কথা জানা গেছে৷ এক, তদন্তে নেমে পুলিশের সন্দেহ, ওই আইরিশ তরুণী শহরের মাদক মোচ্ছব, চলতি কথায় যাকে রেভ পার্টি বলা হয়, তার সঙ্গে সম্ভবত যুক্ত ছিলেন৷ এতে যদিও ওই বিদেশিনীকে ধর্ষণের অধিকার প্রমাণিত হয় না, কিন্তু নিষিদ্ধ মাদক ব্যবহারের পাল্টা আইনি চাপ মানসিকভাবে কিছুটা হলেও দুর্বল করতে পারে ইতিমধ্যেই নিগৃহীত ওই তরুণীকে৷ সেই কারণেই কিনা জানা নেই, ওই আইরিশ তরুণী তাঁর হোটেলের ঘরে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন সম্প্রতি৷
এর একেবারে বিপরীত মেরুর একটি ঘটনার দিকে এবার চোখ ফেরানো যাক৷ কিছুদিন আগে হিমাচল প্রদেশের মানালিতে গণ ধর্ষিতা হন এক অ্যামেরিকান মহিলা৷ ঘটনার দিন ইনি মানালি শহর থেকে কিছু দূরে বশিষ্ঠ বলে একটি জায়গায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন৷ ফেরার পথে, হাইওয়েতে একটি ট্রাক তাঁকে লিফট দিতে চায় এবং মহিলা রাজি হয়ে যান৷ মাঝরাস্তায় ওই ট্রাকের চালক এবং তার সঙ্গী দুই খালাসি মহিলাকে রাস্তার ধারের জঙ্গলে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে৷ এই ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসতেই বিস্তর হইচই শুরু হয়৷ কারণ, ভারতের যে কটি অঞ্চলে বিদেশি পর্যটকদের যাতায়াতের সুবাদে প্রচুর বিদেশি মুদ্রা উপার্জন হয় পর্যটন শিল্পে, হিমাচল প্রদেশ তাদের অন্যতম৷ যদিও সেখানেও মাদক চক্রের পাল্লায় পড়ে সর্বস্বান্ত হওয়া, এমনকি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু মহিলা পর্যটকদের জন্য হিমাচলকে আপাত নিরাপদ মনে করা হয়৷
ফলে তৎপর হয়ে ওঠে হিমাচল প্রশাসন৷ মহিলাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, এর পর যে কদিন তিনি মানালি বা হিমাচলের অন্যত্র থাকতে চান, সরকারি অতিথি হয়ে থাকতে পারেন৷ অর্থাৎ তাঁর থাকা-খাওয়া-ঘোরার সমস্ত খরচ সরকারের হবে৷ মহিলা রাজি হয়ে যান এবং যে গেস্ট হাউসে তিনি ছিলেন, সেখান থেকে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বিলাসবহুল হোটেলে৷ অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারও বার্তা পাঠায়, মহিলা যদি অ্যামেরিকা ফেরত যেতে চান, তাহলে যে কোনও আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার বিজনেস ক্লাসে তাঁর টিকিট কেটে দেবে সরকার৷ কিন্তু যেহেতু ওই মহিলা এখন আরও কিছুদিন মানালিতেই, তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে চান, এখনও সেই সাহায্য নেওয়ার দরকার পড়েনি৷
কিন্তু দুটি ধর্ষণের ঘটনায় প্রশাসন-পুলিশের দুধরনের প্রতিক্রিয়া এটাই প্রমাণ করে যে, একজন বিদেশি মহিলার সম্মান নষ্ট হলে কী করতে হবে, তার সুস্পষ্ট কোনও নির্দেশিকা ভারতে নেই৷ কোথাও তাঁকে আইনি অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে ফেলে নিজেদের দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা নজরে আসে, আবার কোথাও আক্রান্তের নানাবিধ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করে দিয়ে অপরাধ প্রবণতাকে লঘু করার চেষ্টা হয়৷ মানালি এবং কলকাতা, দুটি ঘটনাই কিন্তু আরও একটা বিষয় প্রমাণ করে৷ শিক্ষিত, সপ্রতিভ যুবক অথবা ট্রাক ড্রাইভার, দুই শ্রেণির মধ্যে চরিত্রগত ফারাক বিশেষ নেই ভারতে, অন্তত মহিলাদের সম্মানরক্ষার প্রশ্নে৷ কাজেই বিদেশি পর্যটকদের জন্য লেখা বিভিন্ন গাইডবুকে, ভারতীয় পুরুষদের লালসা আর অশ্লীল আচরণ এড়িয়ে থাকার পরামর্শ যে মহিলাদের দেওয়া হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী৷
ফলে ভারতে বিদেশি মহিলা পর্যটকদের সংখ্যা কমছে৷ গত মার্চ মাসে ভারতীয় বণিক গোষ্ঠী অ্যাসোচ্যাম-এর এক রিপোর্টে ধরা পড়েছে, বিদেশিনী পর্যটকদের এদেশে আসা প্রায় ২৫ শতাংশ কমে গিয়েছে৷ সেটাও কলকাতা বা মানালির ধর্ষণের ঘটনার আগের হিসেব৷ মার্চ মাসেই মধ্যপ্রদেশের দাতিয়া জেলায় এক সুইস মহিলা গণধর্ষণের শিকার হন৷ জানুয়ারিতে মধ্যপ্রদেশেই উমরিয়ায় নিজের হোটেলের ঘরে ধর্ষিতা হন এক কোরীয় মহিলা৷ আর তার আগে, ডিসেম্বরে খাস রাজধানী দিল্লিতে এক বিদেশিনীকে ধর্ষণ করা হয়৷ সমীক্ষা বলছে, যতবার ভারতে এমন ঘটনা ঘটে, তার সরাসরি প্রভাব পড়ে পর্যটনশিল্পে৷