আগাম ভবিষ্যৎ বলে ফেঁসে যাওয়াদের দলটি এবার বেশ ভারী৷
কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে ভারতের সাবেক অধিনায়ককে যখন সংবাদমাধ্যম জেঁকে ধরেছে, ওই সময় চলছিল বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস ম্যাচের ইনিংস বিরতি৷ আফগানিস্তানকে হারিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করার পর টানা চার হারে বিপর্যস্ত সাকিব আল হাসানরা অন্তত ডাচদের বিপক্ষে জয়ের কূল খুঁজে পাবেন- এমন আশার সমাধিও সেই ইডেনেই৷ সেই ম্যাচ হেরে তাঁদের ব্যর্থতার ষোলকলা পূরণ করার পথে অগ্রযাত্রাও আসরজুড়ে কম কৌতূহল ছড়ায়নি৷
নাহ, ইংল্যান্ডের মতো বাংলাদেশকে ফাইনালে তুলে দেওয়ার মতো বোকামি অন্তত কেউ করেননি৷ শ্রীলঙ্কায় এশিয়া কাপ শেষ করার পরপরই এক সাক্ষাৎকারে চন্দিকা হাতুরাসিংহেও বলে দিয়েছিলেন, ‘‘কেউ যদি স্বপ্ন দেখে থাকেন যে, বাংলাদেশ ফাইনালে খেলবে, তাহলে আমি তাঁকে ঘুম থেকে জেগে উঠতেই বলবো৷'' তেমন দিবাস্বপ্ন না দেখালেও সেমিফাইনাল পর্যন্ত যাওয়ার ভরসা ঠিকই জুগিয়েছিলেন৷ বাইরের লোকদের মধ্যে অবশ্য সে সম্ভাবনাও কেউ দেখেননি৷ ব্যতিক্রম বলতে শুধু ব্রেন্ডন ম্যাককালামই৷ তিনি ছাড়া বাংলাদেশকে শেষ চারে দেখেননি আর একজনও৷
কিন্তু দলের পক্ষ থেকে দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে মানুষের আবেগ যোগ হয়ে আশার বেলুন ফুলে-ফেঁপে উঠলেও তা ক্রমেই চুপসে যেতে থাকে৷ যদিও শেষ চারে যাওয়া না হোক, বাংলাদেশ অন্তত নাড়া দেবে এবং বিশ্বকাপে ছাপ রেখে যাবে, তেমন সম্ভাবনা দেখেছিলেন অনেকেই৷ আগের টানা চারটি বিশ্বকাপেই তিনটি করে ম্যাচ জেতা সাকিবদের এবার তিনের ‘গেরো' ছোটাতে না পারার ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে ভিনদেশী অনেককেই তাই আগ্রহী হয়ে উঠতে দেখা গেছে৷ সেটি মহাতারকা থেকে শুরু করে সাংবাদিক নির্বিশেষে৷
স্যার ভিভ রিচার্ডসের কথাই ধরা যাক৷ দূর ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের অ্যান্টিগা থেকে তিনি মুম্বাইতে এসেছিলেন আইসিসির ‘হল অব ফেম'-এ সদ্য অন্তর্ভূক্ত অরবিন্দ ডি সিলভা, বীরেন্দর শেবাগ এবং ডায়ানা এডুলজিদের বরণ করে নেওয়ার আয়োজনে৷ সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে যাওয়া এক বাংলাদেশি সাংবাদিককে এই ক্যারিবীয় কিংবদন্তি উল্টো চাপে ফেলে দেন, ‘‘আপনি তো বাংলাদেশেরই সাংবাদিক৷ তা আপনিই আমাকে বলুন না, ওরা কেন বিশ্বকাপে এত ব্যর্থ হলো?''
সেই ১৩ বছর আগে ‘অর্ডিনারি' দল বলে বাংলাদেশের ক্রিকেট আবেগের দৃষ্টিতে ভিলেন বনে যাওয়া শেবাগও তাই অবলীলায় বলে দিতে পারেন যে সাকিবরা সাধারণের মানোত্তীর্ণ এখনো নন৷ বিশ্বকাপ কাভার করতে ভারতে আসা বাংলাদেশী সাংবাদিকদের অনেককেও নিত্য এই জিজ্ঞাসার মুখে নীরব থাকতে হয়েছে, ‘ইয়ে কেয়া চাল রাহা হ্যায়৷' ভেতরে ভেতরে যা-ই ঘটুক না কেন, প্রকাশ্যে এর ব্যাখ্যা খোঁজার ক্লান্তিতে যেন চোখই বুজে আসতে চেয়েছে টিম ম্যানেজমেন্টের সদস্য থেকে শুরু করে ক্রিকেট বোর্ডের কর্তাদেরও৷
তবে অন্ধ হলেই তো আর প্রলয় থেমে যায় না৷ থামেনি বাংলাদেশ দলেরও৷ ম্যাচের পর ম্যাচ ব্যাটিং অর্ডারের ওলট-পালট প্রশ্ন জাগিয়ে গেছে৷ আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগে তৃতীয় হওয়া দলটি বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত যাঁকে যে জায়গায় খেলিয়ে এসেছে, এখানে এসে রাতারাতি সেটি বদলে দেয়৷ ব্যাখ্যা চাওয়া হলে ভাঙা রেকর্ডের মতো অদ্ভুত এই কথাও বাজিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, ‘‘যার যার জায়গায় ব্যাটিং করলেই যে সফল হতো, সে নিশ্চয়তাও তো নেই৷''
সুচিন্তার বদলে এমন কুচিন্তার প্রতিফলন দলকে কেবলই পিছিয়ে দিয়েছে৷ দূর থেকে দেখে এর কিছুটা বুঝে নিতে সমস্যা হয়নি এমনকি ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিশ্ব জয়ের অন্যতম নায়ক অরবিন্দ ডি সিলভারও, ‘‘বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার ছন্দে ছিল না একদমই৷ ওরা সঠিক সময়ে নিজেদের মেলে ধরতে পারেনি৷ খেলা দেখে আমরা যতটুকু বুঝেছি, কিছু কিছু ক্রিকেটারকে তাদের ভূমিকা হয়তো ঠিকভাবে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি বা তারা বুঝতে পারেনি৷''
ব্যাটিং অর্ডারে একেকদিন একেকজনকে একেক জায়গায় নামানোর ব্যাপারটি যে অনেকের ছন্দোহীনতার অন্যতম কারণ ছিল, পুনেতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচ খেলে বাড়ী যাওয়ার আগে সে সত্য অস্বীকার করেননি সাকিবের জায়গায় দুই ম্যাচে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তও৷ যদিও সেটিকে ব্যর্থতার একমাত্র কারণ বলে ধরে নেওয়ার ভুলেও পড়ার সুযোগ নেই৷ আসর শুরুর আগে থেকে বাংলাদেশ দলের পিছু নেওয়া বিতর্কের উত্তাপও যে ক্ষয়িষ্ণু পারফরম্যান্সে ভূমিকা রেখেছে নিশ্চিতভাবেই৷
দায় আছে রূপকথার চরিত্রের প্রবল বাস্তবের জমিনে আছড়ে পড়ারও৷ ২০১৯ বিশ্বকাপে ৬০৬ রান করার পাশাপাশি ১১ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়ের বিবেচনায় ঢুকে পড়া সাকিবের হাতে এবার নেতৃত্বের হালও আশার বুদবুদ বাড়িয়েছিল৷ মাঝের চার বছরে জুয়াড়ির প্রস্তাব গোপন করে নিষিদ্ধ হওয়া থেকে শুরু করে মাঠ এবং মাঠের বাইরে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে যাওয়া অলরাউন্ডার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে ভিজেছেন তাঁর ক্রিকেটীয় সামর্থ্যরে জন্যই৷ ‘পারলে তিনিই পারবেন' - বদ্ধমূল এই ধারণায় চড়ে সাকিব পৌঁছে গিয়েছিলেন রূপকথার জগতেও৷
তাঁকে নিয়ে তৈরি হওয়া সেই ‘মিথ'ও এবার ভাঙতে শুরু করে৷ সীমাবদ্ধতার জালে তিনিও আটকে যেতে শুরু করেন আগের অনেক অধিনায়কদের মতো৷ এমনিতে বাংলাদেশের অধিনায়কদের বিশ্বকাপে পারফরম করার সুনাম নেই৷ সেটি ১৯৯৯ সালের আমিনুল ইসলাম থেকে শুরু করে ২০০৩-র খালেদ মাসুদ, ২০০৭-র হাবিবুল বাশার এবং ২০১৯-র মাশরাফি বিন মর্তুজাদের সঙ্গে একই ব্র্যাকেটেই উল্টো বন্দী হতে শুরু করেছিলেন সাকিবও৷
পাঁচ ম্যাচে শর্ট বলের ফাঁদে ধরা দেওয়া বাংলাদেশ অধিনায়ক যেন তাঁকে আউট করার নিশ্চিত এক ফর্মুলাই বাতলে দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের বোলারদের৷ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৬৫ বলে ৮২ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংসটি বাদ দিলে নিজের শেষ বিশ্বকাপে তেমন একটা ছাপ রেখে যেতে না পারা সাকিব নিত্য বিতর্কের ধাক্কাও দলের দিকে টেনে এনেছেন৷ এমনিতেই বিতর্কের সঙ্গে সখ্য তাঁর৷ একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেওছিলেন যে, ‘‘আমাকে আপনারা রেখে দিন৷ মিডিয়ার আমাকে প্রয়োজন৷'' নেতিবাচক কারণেও খবরের শিরোনাম হয়ে আসতে অভ্যস্ত এই অলরাউন্ডার বিশ্বকাপ খেলতে দেশ ছাড়ার দিন থেকেই সরগরম রাখেন সংবাদমাধ্যম৷
সতীর্থ তামিম ইকবালকে নিয়ে দেওয়া বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার দলের ওপর বাড়তি যে চাপ নিয়ে আসে, সেটি সামলাতেও এমন হিমশিম খেয়েছেন যে লম্বা সময় সংবাদমাধ্যমের সামনেই আসেননি৷ তবু বিতর্ক পিছু ছাড়েনি৷ তামিমকে দেশে রেখে আসা দলে কোনো বিকল্প ওপেনার না রাখা নিয়েও জোর সমালোচনার স্রোত থামতে না থামতেই দলকে ফেলে রেখে সাকিবের দেশে ফিরে যাওয়ার বিতর্ক৷ ব্যাটিং অর্ডার ওলট-পালট করা নিয়ে ক্রমেই উচ্চকিত হতে থাকা বিরূপ আলোচনার মধ্যে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজকে ‘টাইমড আউট' করার বিতর্কে সাকিবের ইতিহাস হয়ে যাওয়ার ঘটনাও যোগ হয়ে যায়৷
এই বিশ্বকাপের বাংলাদেশ তাই বাজে পারফরম্যান্সের জন্য যতটা সমালোচিত, ঠিক ততটাই বিতর্কিতও৷ বিতর্কে তাঁরা কখনো কখনো ছিল পাকিস্তানের ছবিও৷ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়মিতই বিভিন্ন আসরে পাকিস্তান দলকে নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হতে দেখেছে৷ তবে বিতর্ক ছাপিয়ে অনেক সময় সাফল্যের চূড়াও ছুঁয়ে দেখিয়েছেন পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা৷ সাকিব কি তেমন কিছুই দেখাতে চেয়েছিলেন? চেয়ে থাকলেও বাংলাদেশ কেবল বিতর্কে জয়ের দুয়ারই বন্ধ হতে দেখেছে৷
খুব ভালো না করুক, মাত্র দুই জয় নিয়ে বিশ্বকাপ থেকে ফেরার এমন ভবিষ্যৎও নিশ্চয়ই কেউ আগাম দেখেননি!