বিজ্ঞাপনের সুরক্ষায় কাজ হবে না
৫ জুলাই ২০১৯সেদিনটা এখনো চোখে ভাসে৷ আমার তো পিলে চমকাবার জোগাড়! দুপুর বেলা পাশের বাড়ির বাবু ভাই তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকছেন৷ তাকে বিমর্ষ আর বড় অদ্ভুত দেখাচ্ছিল৷ দুপুররোদ খেলা করছিল তার চকচকে একটা টাকে৷ জর্জ মাইকেলের মতো ঝাকড়া চুল ছিল বাবু ভাইয়ের, যার দুলুনিতে এলাকার আপুদের হৃদয়ে মৃদুকাঁপন জাগত৷ সেই জর্জ মাইকেলের এমন মুণ্ডুপাত!
আগের দিন বিটিভি দেখালো ‘কোথাও কেউ নেই' নাটকের শেষ পর্ব৷ বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়েছে৷ প্রতিবাদে শহরে মিছিল৷ বাবু ভাই সেলুনের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন৷ মিছিল দেখে বললেন, ‘‘পাগলগুলো কী করছে?'' ব্যস, আর যায় কোথায়? সোৎসাহে তাকে ধরণি থেকে উর্ধ্বগগনে উঁচিয়ে নিয়ে সেলুনের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন ‘তারা', বাবু ভাইয়ের ‘কথিত পাগলেরা'৷
খুরের ধার সর্বনাশ করলো তার৷ আয়নাতে তার ঐ মুখটি ছিল বড় অসহায়৷
হুমায়ুন আহমেদের কালজয়ী এই ধারাবাহিক নাটকটিতেও বাকের ভাই চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করা আসাদুজ্জামান নূর এভাবেই ‘সাইজ' করতেন খারাপ ছেলেদের৷ তিনি নিজেও মাস্তান ছিলেন৷ কিন্তু মাইরের মধ্যে যে ‘ভাইটামিন' আছে, সেই ‘ভাইটামিন' যে সমাজের ভালো কাজে লাগে, তেমন ‘ন্যারেটিভ' ছিল তার ও তার গ্যাংয়ের৷ এই চরিত্রটি বাংলাদেশের সমাজজীবনকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে, এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি ঠেকাতে মিছিল হয়েছে রাস্তায়, যা অপূর্বদৃশ্য-বেনজির৷ তবে লেখক তার গল্প বদলাননি৷ তিনি দেখিয়েছেন, সব বাকের ভাইদের জীবন শেষ হয় আস্তাকুঁড়েতেই৷
এবার আরেকটি ঘটনা বলি৷ ২০১৪ সালে ‘পাখি' নামের একটি ড্রেস খুব জনপ্রিয় হয়৷ ভারতীয় স্টার জলসার বিখ্যাত সিরিয়াল ‘বোঝেনা সে বোঝেনা'র পাখি নামের চরিত্রটি এই ডিজাইনের ড্রেস পরেন সিরিয়ালে৷ এই ড্রেস এতটাই জনপ্রিয় হয় যে পত্রিকায় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে ড্রেস না পেয়ে তিনটি মৃত্যু ও একটি ডিভোর্সের ঘটনা পড়ি৷ এর মধ্যে একটি ঘটনা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির একটি মেয়েশিশুর৷ ঈদে পাখি জামা না পেয়ে সে আত্মহত্যা করে৷
এই দুটো ঘটনাতে কয়েকটি বিষয়ের মিল রয়েছে৷ দুটোতেই প্রধান চরিত্র দারুণ জনপ্রিয় হয়৷ দুটোরই পরিণতি হৃদয়বিদারক৷ বাকের ভাইয়ের জন্য দিনের পর দিন কষ্ট পেতে যেমন দেখেছি, তেমনি পাখি পোশাক না পেয়ে এমন আত্মহত্যার খবরও নজরে এসেছে৷
বাস্তবতা আর পর্দার জগতের মাঝে যে সরু দাগটি আছে, তা ধূসর হয়ে গিয়েছিল দুই ক্ষেত্রেই৷ তা সমস্যা নয়৷ সমস্যা হলো, যখন সেখানে ঢুকে যায় অতি কনজিউমারিজম বা পণ্য বেসাতি৷ বাকের ভাইয়ের আঙুলে ঘোরানো চেইনটি একটা স্টাইল হয়ে গিয়েছিল অনেকের কাছেই৷ যুগে যুগে পর্দার অভিনেতা অভিনেত্রীদের পোশাক-আচরণ অনুকরণীয় হয়েছে৷ কিন্তু যখন তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যে এর অভাবে জীবন তুচ্ছ মনে হয়, তখনই সমস্যা৷
সেই পর্যায়ে পৌঁছাবার কাজটি কীভাবে করা হয়? বাস্তবতার সঙ্গে প্রচণ্ড অমিল নিয়ে তৈরি হওয়া সেসব সিরিয়াল, যার মধ্যে প্রচণ্ড মেকাপ আর গয়নায় মোড়ানো জীবনগুলো দেখানো হয়, যেখানে গল্পের চেয়ে প্রাধান্য পায় চাকচিক্য, জীবনের সম্পর্কগুলো বা আবেগগুলোকে আতিশায্যে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা হয়, তখনই বাধে এমন বিপত্তি৷
একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের নাটক দেখবার জন্য পশ্চিমবঙ্গের লোকেরাও অপেক্ষা করতেন৷ কিন্তু উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির সুবিধা নিয়ে আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে সেই চিত্র৷ বাংলাদেশের টিভির পর্দায় এখন কেবল ভারতীয় চ্যানেল৷ সেইসব চ্যানেল জুড়ে থাকে এমন সব আয়োজন৷ সেই আয়োজন দেখবার জন্য টিভির সামনে নিথর হয়ে বসে থাকেন, মা-বাবারা, ক'দিন পর যোগ দেয় শিশুরাও৷ যতক্ষণ দেখায় ততক্ষণই যে এর ভেতরে তারা থাকেন, তা কিন্তু নয়৷ পরে তারা এ নিয়ে গল্প করেন৷ ভাবেন এরপর কী হতে পারে৷ এ এক জগৎ৷ মায়াভরা জগৎ৷
বাংলাদেশের মানুষ কতটা কোন চ্যানেল দেখেন, তা নিয়ে গবেষণা হয়েছে কয়েকটি৷ সেখানে বরাবরই ভারতীয় স্টার প্লাস, সনি, জি টিভি -এসব চ্যানেলের প্রাধান্য৷ প্রথম পাঁচ-দশটি চ্যানেলের মধ্যে তো বাংলাদেশি কোনো চ্যানেলই নেই৷ বাংলাদেশে ভারতের চ্যানেল দেখায়, বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে কেন দেখায় না, এ বিতর্ক অন্য৷
এখানে কথা হলো, এই যে টিভি অনুষ্ঠানের মোহময় ক্ষমতা তাকে কাজে লাগিয়ে এখানকার বাজার দখল করে নিয়েছে প্রতিবেশী দেশটি৷ কারণ, তাদের টিভি ইন্ডাস্ট্রি অনেক বড়৷ অনেক বিনিয়োগ৷ একেকটি অনুষ্ঠানের জন্য আর্টিস্ট তৈরি করতে হাজার হাজার স্কুল আছে ভারতজুড়ে৷ আছে বিজ্ঞাপন৷ সে তুলনায় বাংলাদেশের টিভি এখনো শিল্প হিসেবেই দাঁড়ায়নি৷ তাই ভারতের এত বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন৷
একবার কোনো অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি একজন চ্যানেল মালিক বললেন যে, পে-চ্যানেল দিয়ে ২ হাজার কোটি টাকা বছরে ভারতের আয় আছে বাংলাদেশ থেকে৷ অথচ বাংলাদেশে পে-চ্যানেলই নেই৷ আর যদি এই মায়াভরা জগতের অন্য দিকটা দেখি, পাখি ড্রেসের মতো বলিউডের পোশাক তো আছেই, প্রতিটি সিরিয়ালের পোশাক আর গয়না পাওয়া যায় বাংলাদেশের মার্কেটে৷ কোনো সিরিয়াল শুরু হবার আগেই তার ‘বাইপ্রডাক্ট' বাজারে পাওয়া যায়৷ এর বাজার পে-চ্যানেলের আয়ের চেয়ে অনেক বেশি৷
তাই যখন এখানকার পণ্যগুলো বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতে চায়, তখন দোষ দেখি না আমি৷ তবে মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান হলে দর্শক আসবে, বিজ্ঞাপনও আসবে, এই ধারণা যারা করছেন, তাত্ত্বিকভাবে আমি তা মেনে নিলেও, তা দুই দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনলে তা বাস্তবসম্মত নয় বলেই মানি৷ তাই সরকার দেশি চ্যানেলের জন্য যে সুরক্ষা বলয় তৈরি করতে চাইছে, তা অন্যায্য নয়৷ তবে কোনোটাই সমাধান নয়৷
খেলতে নামলে পুরোটাই খেলতে হবে৷ এই ইন্টারনেটের যুগে দর্শকের কাছে সব খোলা৷ তাই এমন কোনো বাস্তবসম্মত অবস্থায় যেতে হবে, যেখান থেকে দেশীয় চ্যানেলেও মানুষের আগ্রহ থাকবে৷ প্রথাগত উপায়ে দর্শক ধরে রাখা এমনিতেই টিভির পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না, সে জায়গায় দুর্বল কন্টেন্ট নিয়ে ভারতের চ্যানেলের সঙ্গে পাল্লা দেয়া সম্ভব নয়৷ এটা ব্যবসা৷ ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে দেখতে হবে৷ কিন্তু সেই দৃষ্টি হতে হবে সৃজনশীল৷ আমি মনে করি, রাষ্ট্রের উদ্যোগে কিছু মেধাবী সৃজনশীল মানুষকে নিয়ে একটি গবেষণা করা দরকার৷ সেই গবেষণাই বলে দেবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাটি কী হবে৷ তাহলেই বাঁচবে বাংলাদেশের টিভি৷
দেশীয় বিজ্ঞাপন শিল্পের সুরক্ষায় উদ্যোগ নেয়ার কথা বলছে সরকার৷ তাতে কি বাঁচবে এই শিল্প? আপনার মতামত লিখুন নীচের ঘরে৷