বিজেপিকে জবাব দিতে দিতেই ক্লান্ত মমতা
২৮ এপ্রিল ২০১৭রাজনীতিতে এরকম সচরাচর ঘটেছে বলে শোনা যায় না৷ একটি রাজনৈতিক দলের সর্বভারতীয় সভাপতি কোনও রাজ্যে এসে যা মন্তব্য করছেন, যে কটাক্ষ করছেন, রাজ্য সরকার তেড়ে উঠে তারই জবাব দিচ্ছে৷ বিজেপির নির্বাচনী ইতিহাসে তাদের জাতীয় সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ অমিত শাহ'র রীতিমতো হাতযশ আছে৷ অতীতে বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে অমিত শাহ'র তৈরি করে দেওয়া রণকৌশল অনুসরণ করে সাফল্য পেয়েছে বিজেপি৷ সোজা কথায়, অমিত শাহ হলেন নরেন্দ্র মোদী এবং হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবারের সেই সেনাপতি, যিনি বিজেপির যাবতীয় নির্বাচনী যুদ্ধ পরিচালনা করেন৷ কাজেই তাঁকে পশ্চিমবঙ্গে সফরে পাঠানোয় সঙ্গত কারণেই সন্ত্রস্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস৷
রাজ্যে এসে অমিত শাহ যদিও প্রত্যাশিত ছিল না, এমন কিছু বলেননি৷ সামনের পঞ্চায়েত ভোটের কথা মাথায় রেখে উত্তরবঙ্গ থেকে তিনি নির্বাচনী প্রচারের আনুষ্ঠানিক সূচনা করলেন বলা যায়৷ সেই সঙ্গে এ-ও জানিয়ে দিলেন যে, তাঁদের লক্ষ্য ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন৷ দিল্লিতে, সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি, তা একেবারে নির্মূল করাই যে বিজেপির লক্ষ্য, সেটা অমিত শাহ গোপন করেননি৷ এবং চিরকাল যে সমীকরণে ভারতের রাজনীতিতে ভোটার তাঁদের ভোট দিয়ে এসেছেন, সেটাকেই খুঁচিয়ে তুললেন অমিত শাহ৷ বললেন, সংসদে যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা, লোকসভায় তাদেরকেই ভোট দিন৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়নের কর্মসূচিকে জোরদার করুন, মোদীজির ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ' স্লোগানকে জোরদার করুন৷
অর্থাৎ মূল লক্ষ্য লোকসভা ভোট, আর তার জমি তৈরি করতে পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপির প্রচার, প্রসার৷ এর বাইরে অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গ সফরে যা বললেন, তা মূলত রাজনৈতিক কটাক্ষ৷ কিন্তু তাতেই বিচলিত মমতা ব্যানার্জির সরকার৷ এতটাই, যে খোদ মমতা ব্যানার্জি, তাঁর অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং উচ্চশিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অমিত শাহ'র প্রতিটি মন্তব্যের জবাব দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ যেমন অমিত শাহ মন্তব্য করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে আগে এলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যেত, এখন শোনা যায় বোমা ফাটার আওয়াজ৷ এটা নিছকই একটা খোঁচা দেওয়া কথা, যার উদ্দেশ্য প্রতিপক্ষকে উত্যক্ত করা৷ কিন্তু তারও জবাব দিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং অতীব বালখিল্যসুলভ হাস্যকর সেই জবাব, যে অমিত শাহ রাস্তা দিয়ে আসার সময় খেয়াল করেননি যে প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে, ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়ালেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যায়!
অথবা অমিত শাহ কলকাতা প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, আগে পশ্চিমবঙ্গে কত শিল্প ছিল! এখন স্রেফ একটাই শিল্প – বোমা বানানো! ফের সেই খোঁচা মারা মন্তব্য৷ কিন্তু এরও জবাব দিলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র৷ তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, পশ্চিমবঙ্গ শিল্পেও কতটা এগিয়ে৷ যদিও সেই পণ্ডশ্রম করার কোনও দরকার ছিল না৷ কারণ, বিজেপির এবারের প্রচারের পুরোটাই ছিল সস্তা রাজনৈতিক চমকে ভরা৷ নকশালবাড়িতে আদিবাসী বাড়িতে দুপুরের খাওয়া সারা বা কলকাতার চেতলা এলাকার এক বস্তিতে ঘরে ঘরে ঢুকে কথা বলা, এ সবই ছিল সেই চমকেরই অঙ্গ৷ কিন্তু তাতেও উত্যক্ত মুখ্যমন্ত্রী কটাক্ষ করেছেন, দুপুরে গরিবের বাড়িতে খেয়ে, রাতে পাঁচ তারা হোটেলে ডিনার খায় এরা! অথচ অগ্রাহ্য করলেই হতো৷ অমিত শাহর এই সফর নিয়ে বেশি কথা বলে বরং মমতা ব্যানার্জিই এই সফরকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেললেন৷
আর মমতা ব্যানার্জি ক্ষেপেছেন বামেদের ওপর৷ কারণ, তিনি চেয়েছিলেন, রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বামেরা তাঁর পাশে থাকবেন৷ কিন্তু মমতাকে বিপাকে ফেলার এমন সুযোগ বামেরাই বা কেন ছাড়েন! ক্ষিপ্ত মমতা তাই একমুখে যেমন বিজেপির সমালোচনা করছেন, অন্যমুখে তেমনি অভিযোগ তুলছেন বাম-বিজেপি গোপন আঁতাতের৷ সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘এটা নতুন কিছু নয়৷ মমতা যখনই বিপদে পড়েন, তাঁর মুখে বামেদের নাম শোনা যায়৷ কিন্তু মমতাই একসময় খাল কেটে কুমির এনেছিলেন৷ বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করে এই রাজ্যে হিন্দুত্ববাদকে বাড়তে দিয়েছিলেন৷ আর ক্ষমতায় আসার পর তাঁর সরকার একদিকে যেমন হিন্দুত্ববাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে মুসলিম মৌলবাদকে মদত জুগিয়েছে৷ ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের জন্য মমতা ব্যানার্জিই দায়ী৷ কাজেই তার জন্য এখন বামপন্থীদের দোষারোপ করলে কী করে হবে!''