আন্দোলনের মেয়াদ কতো?
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
গত ৬ই জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ-হরতালের মধ্যে বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট গত শনিবার ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছিল৷ কিন্তু বাস্তবে তাদের বিক্ষোভ মিছিল হয়নি৷ যা হয়েছে তা হলো ঝটিকা মিছিল৷ ঢাকায় ১৬/১৭টি পয়েন্টে বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা হঠাত্ ব্যানার বের করে কয়েক মিনিট মিছিল করে আবার কেটে পড়েন৷ ঢাকার বাইরেও কয়েক জায়গায় একইভাবে ঝটিকা মিছিল বের করেন তাঁরা৷ কিন্তু এ সব মিছিলে কারাগারের বাইরে থাকা বিএনপির কোনো শীর্ষ নেতাকে দেখা যায়নি৷ তারপরও তাঁরা আওয়ামী লীগের বাধা এবং পুলিশের প্রতিরোধের মুখে পড়েন৷ এমনকি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ২৬ জনকে আটক করা হয়৷
অবরোধের মধ্যে এখন বিএনপির ৭২ ঘণ্টার হরতাল চলছে৷ এই হরতাল শেষ হবে বুধবার ভোর ৬টায়৷ হরতালের দ্বিতীয় দিন সোমবার, রাজধানীতে এই হরতালের প্রভাব খুব বেশি দেখা যায়নি৷ রাজধানীর ফার্মগেট, বাংলামটর, মতিঝিল ও গুলিস্তানসহ কয়েকটি এলাকায় রীতিমত যানজটের সৃষ্টি হয়৷ ৭২ ঘণ্টা হরতালের শুরুর দিন রবিবারেও একই চিত্র দেখা গেছে রাজধানীতে৷ তবে দূর পাল্লার যানবাহন চলছে কম৷
অবরোধ-হরতালে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মাঠে দেখা না গেলেও মাঠে রয়েছে আওয়ামী লীগ৷ বিশেষ করে নৌ-মন্ত্রী শাহজাহান খানের নেতৃত্বে সোমবার খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় ঘোরাও করা হয়৷এখানে গত ৩রা জানুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া অবস্থান করছেন৷
ঘেরাও কর্মসূচি প্রসঙ্গে নৌ-মন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘এখান থেকে খালেদা জিয়া ও লন্ডন থেকে তাঁর ছেলে তারেক রহমান বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো বানানোর যে চেষ্টা করছে, আমরা তা বাস্তবায়ন করতে দেব না৷'' তাই তিনি গুলশান থেকে খালেদা জিয়ার কার্যালয় সরিয়ে নেয়ারও দাবি জানান৷
আগামী ১৮ই ফেব্রুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে ট্রাক মিছিল ও ১৯শে ফেব্রুয়ারি শ্রমিক, কর্মচারী,পেশাজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের ব্যানারে মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পতাকা মিছিলের কর্মসূচিও ঘোষণা করেন নৌ-মন্ত্রী৷
অন্যদিকে রবিবারে হাইকোর্টের একটি আদেশ সরকারের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে৷ কিন্তু একই আদেশ বিরোধী নেতা-কর্মীদের আরো চাপের মুখে ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
হাইকোর্ট চলমান হরতাল-অবরোধের প্রেক্ষাপটে ‘নৈরাজ্য বন্ধ' করার প্রয়েজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে৷ পাশাপাশি ‘নৃশংস অবরোধ' কেন অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না – তা জানতে চেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুল জারি করা হয়েছে৷এছাড়া হরতাল-অবরোধ ডাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে না – সেটা জানতে চেয়েও রুল জারি হয়েছে৷
অন্যদিকে এসএসসি পরীক্ষা নির্বিঘ্ন করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট৷ হরতাল বা অবরোধের নামে পরীক্ষা নেয়ায় কোনো বাধা দেওয়া হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷
ওদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আলোচনায় বসার পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দিয়ে সহিংসতা বন্ধেরও আহ্বান জানাচ্ছে৷ হরতাল-অবরোধে সারা দেশে সহিংসতায় এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন অন্তত ৬৯ জন৷ এঁদের মধ্যে পেট্রোলবোমা-ককটেল হামলায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন অন্তত ৫২৷
এই পরিস্থিতিতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের একাংশ হতাশ হয়ে পড়েছেন৷ বিশেষ করে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের হতাশা বাড়ছে৷ ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার যুবদল নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ বাবলু ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘কেউ কারুর খোঁজ রাখছেন না, নেই কোনো সমন্বয়৷ সংবাদমাধ্যমে বিবৃতির মাধ্যমে আমরা কর্মসূচির খবর পাই৷ আমরা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছি৷ কেন্দ্রীয় নেতাদের দেখা পাই না বা তাঁদের সঙ্গে কথাও হয় না৷''
তিনি বলেন, ‘‘টানা মাসব্যাপী বা কয়েকমাস ধরে চলা আন্দোলনের অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের নেই৷ তাই অনেকেই ক্লান্ত হয়ে ঘরে বসে আছেন৷ গ্রেপ্তার এড়াতে অনেকেই নিজ বাসায় থাকছেন না৷ কর্মসূচিতে অনেকেই যোগ দিতে পারছেন না৷''
মগবাজার এলকার ছাত্রদল নেতা সাইফুল ইসলাম রনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আন্দোলন সফল না হলে আমাদের পরিণতি আরো খারাপ হবে৷ কিন্তু আন্দোলন সফল হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ এখনো স্পষ্ট নয়৷ সরকার পদত্যাগ তো দূরের কথা, আলোচনাতেই রাজি হচ্ছে না৷ আর এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপও এত তীব্র নয়৷ বরং নাশকতার দায় পড়ছে আমাদেরই ওপর৷ সব মিলিয়ে হতাশ হয়ে পড়ছি৷''
এদিকে আন্দোলনের কর্মসূচি ঠিক করছেন খালেদা জিয়া এবং তাঁর বড় ছেলে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷ এরপর বিএনপির কোনো নেতা অজ্ঞাতস্থান থেকে বিবৃতির মাধ্যমে সেই কর্মসূচি জানাচ্ছেন৷ এরইমধ্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদের একটি বিবৃতি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে৷ ঐ বিবৃতি বিএনপির বিবৃতি নয় বলে আরেক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে৷ তাই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা আন্দোলনের গতি প্রকৃতি নিয়ে অনেকটাই অন্ধকারে৷
তবে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা আহমেদ আযম খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হরতাল অবরোধে কোনো ঢিলেমি আসেনি৷ নেতা-কর্মীরাও ক্লান্ত হয়ে পড়েননি৷ বরং নেতা-কর্মীরা আরো উজ্জীবীত হয়েছেন৷ আন্দোলন আরো তীব্র হয়েছে৷ যেসব নেতা-কর্মী এতদিন ঘরে বসেছিলেন তাঁরাও এবার আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন৷ কারণ তাঁরা বুঝতে পারছেন যে, এই স্বৈরাচারী সরকারকে আন্দোলন করে হটানো ছাড়া বাঁচার আর কোনো পথ নেই৷''
তিনি বলেন, ‘‘বিএনপির দীঘদিন ধরে আন্দোলনের ইতিহাস আছে৷ স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে মাসের পর মাস নয়, বছরের পর বছর বিএনপি আন্দোলন করেছে৷ নেতা-কর্মীরা মাঠে থেকেছেন৷ তাই বর্তমান সময়ে মাত্র দেড় মাসে ক্লান্ত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না৷''
আযম খান দাবি করেন, ‘‘নেতা-কর্মীদের ব্যাপক ধর-পাকড়ের কারণে শনিবার ঢাকার বিক্ষোভ মিছিল হয়ত তেমন সফল হয়নি৷ তবে ঢাকার বাইরে কর্মসূচিতে ব্যাপক লোকের সমাগম হয়েছে৷''
হাইকোর্টের নির্দেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি শান্তিপূর্ণ অবরোধ-হরতাল পালন করছে৷ সরকার নাশকতা করে তার দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে৷'' তাঁর কথায়, ‘‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শুক্র ও শনিবারেও হরতাল দিয়েছে৷ তাদের কারণে তিন মাস পরীক্ষা পিছিয়ে গিয়েছিল৷ আর বিএনপি এবার এসসসি পরীক্ষার জন্য শুক্র এবং শনিবারে হরতাল দিচ্ছে না, যাতে ঐ দু'দিনে এসএসসি পরীক্ষা নেয়া যায়৷ হরতাল-অবরোধে সরকার চাইলেই এসএসসি পরীক্ষা নিতে পারে৷ বিএনপি তো বাধা দিচ্ছে না!''