বিএনপির পরবাসী আন্দোলন
২৬ অক্টোবর ২০১৪কথায় জোর আছে বিএনপি নেতাদের৷ সরকারের শুধু পতনই নয় টেনে-হিঁচড়ে গদি থেকে নামানোর কথাও বলেন তাঁরা৷ আর তা গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রচারও হয়৷ বক্তৃতা, বিবৃতি, টকশো আছে বলেই হয়তো ডিজিটাল মাধ্যমে আন্দোলনের গরম হাওয়ার কথা শোনা যায়৷ অথবা কাগুজে তেজ ছাপা হয় পত্রিকায়৷ কিন্তু বিএনপির মাঠের তেজ দেখা যায়না৷ এক শীত পেরিয়ে আরেক শীত দরজায় কড়া নাড়ছে৷ মাঝে চলে গেছে গ্রীষ্ম-বর্ষার মত আরো অনেক ঋতু৷ কিন্তু বিএনপির শীত আর কাটে না৷ যেন এক দীর্ঘ শীতনিদ্রায় আছে দলটি৷
মাঝে মাঝে যে বিএনপি তপ্ত হয় না, তা নয়৷ এই যে সর্বশেষ ছাত্রদলের নতুন কমিটি নিয়ে এক দফা হয়ে গেল৷ নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ৷ পদ না পাওয়া ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা শুধু বিক্ষোভ বিদ্রোহই করেন নি৷ অফিসে তালাও লাগিয়ে দেন৷ তাহলে আর সরকারকে তালা দেবে কে? এর আগে ঢাকা মহানগর কমিটি গঠন করা হয়৷ সেখানেও একই অবস্থা৷ কমিটি দিয়ে আন্দোলন চাঙ্গা করার আশায় পানি পড়েছে৷ কারণ আহ্বায়ক মীর্জা আব্বাস মানতে পারছে না বয়সে তরুণ নেতা হাবিব উন নবী খান সোহেলকে৷ তাই এই দলের মহাগরের নেতা-কর্মীরা দুই ভাগ৷ বিভক্তিতে শক্তি ক্ষয়, আন্দোলন আর হয় না৷ ঘর সামলাতেই সময় কেটে যায়৷
আর আছে সিনিয়র নেতাদের আভিজাত্য এবং কথিত ষড়যন্ত্র৷ নেতারা মাঠে নামেন না, মামলা আর পিটুনির ভয়ে৷ তারা ঘরে বসেই গরম কথা বলেন৷ আর কর্মীরা মাঠে নেতা না পেয়ে দিকহারা, অসহায়, বিভ্রান্ত৷ তার মাঝে মওদুদ আহমেদরা নতুন বই লিখে আলোচনার জন্ম দেন৷ দলের ভেতরেই ‘ষড়যন্ত্রকারীদের' আচরণে বিএনপি বিপাকে পড়ে৷ চলে নতুন করে বিবৃতি বক্তব্য৷ সরকারের দোসর খোঁজা হয় দলের মধ্যেই৷ তাহলে উপায়!
গত কয়েকদিনে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া আবার মাঠ গরম করার মত কথা বলেছেন৷ বলেছেন কঠোর আন্দোলন শুরুর৷ কিন্তু তাতেও কী ভরসা পাচ্ছেন নেতা-কর্মীরা৷ পাবেন কীভাবে! বুধবার এক জনসভায় চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত হতে বললেও আন্দোলন কবে শুরু হবে তা বলেননি দলের চেয়ারপার্সন৷ খালেদা জিয়া অবশ্য বলেছেন ৫ জানুয়ারি আগে সারাদেশে আন্দোলন সফল হয়েছে৷ ব্যর্থ হয়েছে ঢাকা৷ তার ভাষায়, ‘‘আমরা ব্যর্থ হয়েছি৷ আপনারা ব্যর্থ হননি৷'' এবার নাকি ঢাকাও সফল হবে বলে তিনি আশাবাদী
আর এই চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি তিনি এর আগে বহুবার দিয়েছেন৷ যার মধ্যে রোজার পরে, ঈদুল ফিতরের পরে, ঈদুল আজহার পরে অন্যতম৷ এরপর হয়তো শোনা যাবে নতুন বছরের শুরুতে৷ দেখে শুনে মনে হচ্ছে বিএনপি হয়তো আন্দোলন শুরুর জন্য পঞ্জিকা নিয়ে গবেষণা করে শুভ দিনক্ষণ খুঁজে পাচ্ছে না৷
আর এই আন্দোলনের একটি সুতা আবার প্রবাসে৷ খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান লন্ডনে বসে সেই সুতা নাড়াচাড়া করেন৷ তিনি রোজার ঈদে দেশের নেতাকর্মীদের ঈদকার্ড এবং লিখিত বার্তা পাঠিয়ে ঈদের পর চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন৷ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছিলেন বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে আন্দোলন বিমুখতার৷ কিন্তু তাঁর ঈদ কার্ড আন্দোলন বার্তায়ও চাঙ্গা হয়নি দল৷ হবে কীভাবে তারেক রহমান নাকি তাঁর বিশ্বস্ত কয়েক নেতাকে ‘সরকারের দুর্নীতির শ্বেতপত্র' তৈরির কাজ দিয়েছিলেন৷ তিনি আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন শ্বেতপত্র প্রকাশের মাধ্যমে৷ কিন্তু সেই শ্বেতপত্র আর হয়নি৷ নেতারা ফাঁকিবাজি করেছেন৷ তারা নাকি পেপারকাটিং থেকে তথ্য নিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছেন৷ যা তারেক রহমানকে যারপরনাই আশাহত করেছে৷ আর এখন তো তিনি নতুন করে উপদেষ্টা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন৷ তাঁর উপদেষ্টা ব্যারিষ্টার আবু মোহাম্মদ সায়েম ২১ অক্টোবর লন্ডনে আটক হন জালিয়াতির অভিযোগে৷ অবশ্য ছাড়া পেয়ে তিনি উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন৷
৫ জানুযারির নির্বাচনের পর বিএনপি একবার হরতাল করেছে৷ তাও আবার জামায়াতের হরতালের সঙ্গে মিলিয়ে৷ জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ডের প্রতিবাদে ১৮ ও ২১ সেপ্টেম্বর হরতাল পালন করে জামায়াত৷ বিএনপি হরতাল পালন করে ২২ সেপ্টেম্বর৷ এই হরতাল ডাকে বিএনপি হঠাত্ করেই৷ তা আবার নির্বাচনের দাবিতে নয়, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাশের বিরুদ্ধে৷
আর রবিবার আরেকটি হরতাল ডেকেছে বিএনপিপন্থি ইসলামী দলগুলো৷ তারা হজ নিয়ে মন্তব্যকারী সদ্য সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীতে গ্রেফতারের দাবিতে এই হরতাল ডেকেছেন৷ সিদ্দিকী মন্তব্য করে তিনি মন্ত্রীত্ব হারিয়েছেন, দল থেকে বহিস্কার হয়েছেন৷ আর এখন ভারতে অবস্থান করছেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে৷ সরকারের মন্ত্রীরা এরইমধ্যে অভিযোগ করেছেন এই হরতাল ডাকিয়েছে বিএনপি৷ কারণ রবিবার একটি দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরার তারিখ রয়েছে৷
তবে বিএনপির ইন্ধন থাকলেও এই হরতাল যে তেমন কার্যকর হবে তা আশা করা যায় না৷ কারণ বিএনপি ২২ সেপ্টেম্বরের হরতালও সফল করতে পারেনি৷
বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে বলেন, সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন ও মামলা হামলার কারণে নেতাকর্মীরা কোনঠাসা৷ তাই তারা মাঠে নামতে পারছেন না৷ তবে তাদের ধারণা দেশের মানুষই সরকারকে বিদায় করবে৷ তাদের কথা দিন তারিখ দিয়ে আন্দোলন হয় না৷ সময় এলেই আন্দোলন হবে৷ তবে তাদের ভিতরের কথা আলাদা৷ তারা মনে করেন, দলকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করতে আরো অনেক সময় লাগবে৷ কারণ নেতাকর্মীরা এখন আর ভরসা পাচ্ছে না৷ সরকারের পতন না হলে আবার আন্দোলনে নেমে কেউ বিপদে পড়তে চাইছে না৷ তার তাই কূটনৈতিক তত্পরতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন৷
বিএনপির এই আন্দোলন অসারতা নিয়ে সরকারী দলের মন্ত্রীরাও বেজায় খুশি৷ তারা বার বারই বলছেন বিএনপির আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই৷ বিএনপি কোন কর্মসূচি সফল করতে পারবে না৷ আর তাই নির্বাচনতো দূরের কথা বিএনপিকে সংলাপেরই সুযোগ দিতে চাইছে না সরকার৷ বলছে নির্বাচনের জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে৷ সরকার বিএনপিকে অপেক্ষায় রাখছে আর বিএনপি আছে আন্দোলনের অপেক্ষায়৷