বাড়ছে পিঠার বাণিজ্যিক কদর
১৫ জানুয়ারি ২০১৯রাত-দিন ঢেঁকিতে চাল কুটে পিঠা বানানোর সংস্কৃতিতেও ভাটা পড়েছে৷ পিঠা বানানোর উদ্দেশ্যে শহরের চালের কলে নিত্য ভাঙানো হচ্ছে চাল৷ গ্রামেও এখন ঢেঁকির পরিবর্তে কলে চাল ভাঙানো হচ্ছে৷ সময় বদলেছে পিঠা তৈরির ও খাওয়ার ধরন বদলেছে৷
পিঠার কদর বা সংস্কৃতিতে যে ভাটা পড়েনি সেটি ঢাকা বা অন্যান্য জেলা শহরগুলোর অলিতে গলিতে গজিয়ে ওঠা পিঠার দোকান বা ভ্যানের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়৷ পিঠার দোকান ও ভ্যানের সবচেয়ে কমন পিঠা তেলে পিঠা বা পোয়া, চিতই ও ভাপা৷ গরম, ধোঁয়া ওঠা ভাঁপা অবশ্য শীতকালেই চলে৷ তবে বছর জুড়ে নাগরিক জীবনে নাস্তার চাহিদা মেটাচ্ছে চিতই৷ ৭-৮ রকমের ভর্তা দেওয়া এই পিঠার দাম ৫-১০টাকা৷ তাই ভরপেট নাস্তা বা বৈকালিক খাবারের চাহিদা এই পিঠাই মেটাচ্ছে৷
নতুন ধান তোলার পর থেকেই পিঠা তৈরির আয়োজন করা হয়৷ শীতের ও পৌষ পার্বণের সময় বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে পিঠা তৈরি করা হয়৷ পিঠা সাধারণত মিষ্টি স্বাদের হযলেও ঝাল, নোনতা বা অন্য যে কোনো স্বাদও হতে পারে৷
বাংলাদেশের পিঠার নাম বলে শেষ করা যাবে না৷ অঞ্চলভেদে এমনকি গ্রামভেদে পিঠার ধরন, উপকরণ আলাদা হয়৷ চালের গুঁড়া ছাড়া পিঠায় মূল উপকরণে মিল পাওয়া কঠিন৷ এসব পিঠার মধ্যে পরিচিত পিঠাগুলো হচ্ছে ভাপা, চিতই, পোয়া, মাল পোয়া ছাঁচ পিঠা, ছিটকা, আস্কে, চুটকি পিঠা, চাপড়ি, চাঁদ পাকন, ছিট, সুন্দরী পাকন, সরভাজা, পুলি, চন্দ্রপুলি, মুখ সল্লা, পাতা পিঠা, পাটিসাপটা, মুগ পাক্কন, মেরা পিঠা, মালাই পুলি, মুঠি পিঠা, আন্দশা, কুলশি, খেজুর কাটা নকশি, কলা/পানা পিঠা, খেজুর ঝুরি, ক্ষীর কুলি, গোকুল, গোলাপ পাক্কন, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল, ঝিনুক, দুধরাজ৷
এসব পিঠার সবই যে দোকানে বা বাজারের ভ্যানে পাওয়া যায়, বিষয়টি তেমন নয়৷ বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে এসব পিঠা অর্ডার করে পাওয়ার সুযোগ রয়েছে৷ ঢাকার অধিকাংশ মিষ্টির দোকানে পাওয়া যাচ্ছে পিঠা৷ এমনকি অনলাইন ফুড আউটলেটেও নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে পিঠা৷
অনলাইন ফুড আউটলেট ‘ধবল' পিঠা বিক্রি করছে ২ বছর ধরে৷ এর কর্ণধার আসমা হক কান্তা জানালেন, ‘‘২০১৬ সালের শেষ দিক থেকে পিঠা সাপ্লাই শুরু করেছি৷ প্রতিদিন গড়ে ৩০-৪০টা আইটেমের অর্ডার আসে ক্রেতাদের কাছ থেকে৷'' পিঠা সরবরাহ করে কুলিয়ে ওঠা যায় না বলে তিনি জানান৷ হাতে কাটা সেমাই, দুধ পুলি, ভাপার চাহিদা সবচেয়ে বেশি তাঁর প্রতিষ্ঠানে৷ শীতকালে পিঠা উৎসবের মতো বড় বড় আয়োজনেও তাঁকে পিঠা দিতে হয়েছে৷ কর্পোরেট ক্লায়েন্টদেরও পিঠার চাহিদা প্রচুর৷ ৮ জন নারী প্রতিদিন পিঠা তৈরি করছেন তাঁর এখানে৷ দুজন ব্যক্তিগত ডেলিভারি ম্যানসহ বাইরের ডেলিভারি সার্ভিস নিত্য কাজ করে যাচ্ছে পিঠা সরবরাহের৷
অন্যদিকে দেশি খাবারের দোকান মাদল খাবার ঘরের বড় অনুষঙ্গ পিঠা৷ পান্থপথের এই দোকানে সামনাসামনি পিঠা বানিয়ে পরিবেশন করা হয় আর সকাল থেকেই শুরু হয় পিঠার নানা আইটেম বিক্রি৷ বিয়ে বাড়ি, ঢাকা লিট ফেস্টের মতো বড় বড় আয়োজনে মাদল পিঠা সরবরাহ করেছে, কোথাও লাইভ পিঠা শো-ও করেছে৷ মাদলের কর্ণধার মাসুমা খাতুন শাম্মি জানান, ‘‘সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লাইভ পিঠা বানানো চলে মাদলে৷ এর মাঝে তিন ঘণ্টা ব্রেক থাকে কর্মচারীদের৷ কিন্তু অধিকাংশ সময় অতিরিক্ত অর্ডারের চাপে অনবরত পিঠা বানিয়ে যান তাঁরা৷''
শুধু মাদল খাবার ঘরে নয়, বিয়ে বাড়ির মতো আয়োজনেও লাইভ পিঠা করেছে মাদল৷ এখানে অন্য খাবারের তুলনায় পিঠার চাহিদা বেশি৷ বেশিরভাগ সময় লাইন ধরে পিঠা কেনেন ক্রেতারা৷ মাসুমা খাতুন শাম্মি মনে করেন, এই সময় শিশু, কিশোর ও তরুণরা ফাস্টফুড সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে পিঠার ভক্ত হচ্ছে৷ তিনি এ-ও জানান, গত ঢাকা লিট ফেস্টে তিনি স্ন্যাকস আইটেম হিসেবে সিঙ্গারা, সমোসা, রোল রেখেছিলেন, এবার যোগ করেছিলেন পিঠা৷ দেশি-বিদেশি লেখক ও অতিথি সবাই পিঠাই খেয়েছেন বেশি৷
এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন ফুড সাপ্লায়ার চেইন কুকআপ৷ ঘরে তৈরি খাবার বাড়িতে যে-কোনো আয়োজনে কিংবা অফিসের আয়োজনে পৌঁছে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি৷ এই শীতে পিঠার চাহিদা দারুণ বলে জানালেন কুকআপের সিইও ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা নামিরা হাসান৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা যেহেতু হোমমেড খাবার সাপ্লাই করি, আমাদের প্লাটফর্মে পিঠা ভীষণ চলে৷ আমাদের ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয়৷ সারা বছর নানা ধরনের পিঠা চললেও এই শীতে চাহিদা বেশি বেড়েছে৷ আমরা ভাপা, ক্ষীরসা, দুধপুলির মতো পিঠাগুলো সরবরাহ করি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী৷ বিয়ে বাড়ির মতো আয়োজনেও পিঠা সরবরাহ চলছে৷''
মোটামুটি সব ফাস্টফুড শপ, মীনা সুইটস, টেস্টি ট্রিট, বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, প্রিমিয়াম সুইটসের মতো মিষ্টির দোকানগুলোও এখন পিঠার দিকে নজর দিচ্ছে৷ দেশের প্রতিটি জেলায় শিল্পকলা একাডেমি নিয়মিত শীতকালে পিঠা উৎসব করে আসছে৷ এবং এ সব মেলায় বিক্রিও সন্তোষজনক ও পিঠার চাহিদা লক্ষণীয়৷
হয়ত সময়ের অভাবে মা, খালাদের হাতের ছোঁয়া পিঠার আয়োজন কমেছে, কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে এর চাহিদা বেড়েছে৷
ফাতেমা আবেদীন নাজলার এই লেখাটি কেমন লাগলো জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷