বাড়ছে একাকিত্ব, ঠিকানাহীন সমাজ
১১ জুলাই ২০২২অবশ্য বিচ্ছিন্নতা এখন শিশুদের মধ্যেও প্রবল। শিশুরা এই কারণে অনেকটা অসামাজিক হয়ে ঘরে বন্দি থাকছে। তারা গেজেট নির্ভর হয়ে পড়ছে। তাদের পৃথিবীও ছোট হয়ে আসছে।
গত ৭ জুলাই ঢাকার মগবাজার এলাকার একটি ফ্ল্যাটের সাত তলায় পুলিশ দরজা ভেঙে ইকবাল উদ্দিন নামে এক চিকিৎসকের গলিত লাশ তার নিজের বাসা থেকে উদ্ধার করে । তার দুই ছেলে মেয়ে এবং স্ত্রী দেশের বাইরে থাকেন। তিনি অসুস্থ অবস্থায় একাই ওই বাসায় থাকতেন। আত্মীয় স্বজনের সাথে ফোনেই যোগাযোগ হতো।
পুলিশ ৯৯৯-এ কল পেয়ে তার লাশ উদ্ধার করে। উদ্ধারের কয়েকদিন আগে মারা গেলেও কেউ জানত না। তার লাশ পঁচে গন্ধ বের হচ্ছিল।
গত বছরের ১৭ এপ্রিল উত্তরার বাসা থেকে পুলিশ অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমানের লাশ উদ্ধার করে। এই খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও একলা তার ফ্লাটে থাকতেন।
চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর আবু মোহসিন খান চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি তার ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে ফেসবুক লাইভে মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তিনিও নিঃসঙ্গ ছিলেন। ঢাকা শহরে গত কয়েক বছরে নিঃসঙ্গতার কারণে আত্মহত্যা বা একাকি বাসায় মারা যাওয়ার পর লাশ কয়েকদিন পর উদ্ধারের আরো কিছু ঘটনা আছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন বাংলাদেশে গ্রামে এখনো একাকিত্বের চাপ তেমন নেই। পারিবারিক বন্ধন এখনো ততটা আলগা হয়ে যায়নি সেখানে। যদি তাই হতো তাহলে এত মানুষ পথের কষ্ট আর বাধা উপেক্ষা করে পরিবারের লোকজনের সাথে ঈদ বা উৎসব আয়োজনে অংশ নিতে গ্রামে ছুটতো না। তারপরও শহুরে সমাজ এবং শিক্ষিত ও বিত্তশালীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা আতঙ্কজনক। তারা এর জন্য দায়ী করেন-
১. রাষ্ট্র ও রাজনীতির চরিত্র ২. অর্থনীতি ৩. সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ ৪. অপরিকল্পিত নগরায়ন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন মনে করেন এর পিছনে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রতিযোগিতা একটা কারণ। তিনি বলেন,"কৃষি নির্ভরতা যত কমছে ততই এই বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। শিল্প নির্ভরতা ভ্যালু অ্যাডিশন বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার শহরে যে কোনো কাজের ভ্যালু অ্যাডিশন বেশি। প্রতিযোগিতাও বেশি। এটা শহুরে মানুষকে বিচ্ছিন্ন এবং পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বি করছে। এটা পরিবারেও ঘটছে। এটাই শহুরে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করছে। নিজের স্বার্থ ও প্রয়োজন ছাড়া অন্যের সাথে যোগাযোগ কমে যাচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক এটাকে রাষ্ট্র ও রাজনীতির কাঠামোর মধ্যে দেখেন। তিনি বলেন,"রাষ্ট্র তার নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রক্রিয়া যদি অনুসরণ না করে তার প্রভাব সবখানে পড়ে। আর রাজনীতিতে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার পরও যদি মূল টার্গেট ঐক্য না হয় তাহলে সব ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা হবে।”
তার কথা," বিশ্বে কোথায় কী হয়েছে সেটা বড় কথা নয়। আমাদের এই জনপদের সংস্কৃতি হলো ঐক্যের সংস্কৃতি, একসাথে থাকার সংস্কৃতি। সেটা পরিবর্তন হচ্ছে। যার ফলে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন আলগা হয়ে যাচ্ছে। পারিবিারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ আত্মকেন্দ্রিকতার দিকে যাচ্ছে। যার পরিণতি এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা একটি ঠিকানাহীন সমাজের দিকে যাচ্ছি।”
এই প্রবণতা বিত্তশালী ও শিক্ষিতদের মাঝে বেশি। ফলে দেখা যাচ্ছে সম্পদের ভাগ বটোয়ারার দ্বন্দ্বে পিতার লাশ দাফন না করে দিনের পর দিন রেখে দেয়া হচ্ছে। পিতা-মাতাকে আলাদা রাখা হচ্ছে আর্থিক সক্ষমতার সুযোগ নিয়ে। আর ধনীরা প্রবল প্রতিযোগিতার দৌড়ে পরিবারে বয়স্কদের সময়ই দিচ্ছেন না।
আর নিম্নবিত্তরা বেঁচে থাকার জন্য নিজেদের প্রয়োজনেই কম বিচ্ছিন্ন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ মনে করেন,"যৌথ পরিবারে এই সমস্যা অনকে কম। বাস্তবতার কারণেই যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। কোনটা ভাল, যৌথ না একক পরিবার সেটা নিয়ে নানা মত আছে। কিন্তু একক পরিবার হলেও সেটা পরিবার হতে হবে। কিন্তু আমার কথা হলো আদর্শ পরিবার ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ছে। এটাই সমস্যা।”
তিনি বলেন,"বয়স্করা এখন আর আড্ডা দিতে পারেন না, আগে যে পাড়ার ক্লাব বা চায়ের দোকানে আড্ডা দিতেন তা এখন আর নেই। তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। তারা রাজনৈতিক আলাপ পছন্দ করেন। সেই সুযোগও এখন কমে আসছে। আর পরিবারের অন্য সদস্যরা ব্যস্ত থাকায় তারও সময় দেন না। আলাদা থাকলে তো কথাই নেই। পুরোপুরি বিছিন্ন হয়ে পড়েন।”
শিশুদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন,"শহুরে শিশুদের বাবা-মা ব্যস্ততার কারণে সময় দেন না। তাদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠও নেই। বাবা-মা নিরাপত্তার কারণে শিশুদের বাইরে যেতে দিতে চান না। সব মিলিয়ে তারাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ইলেট্রনিক গেজেট নির্ভর হয়ে পড়ছে। একা বয়স্কদের ক্ষেত্রেও ঘটছে।”
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বির হোসেন মনে করেন অপরিকল্পিত নগরায়নই এই বিচ্ছিন্নতার জন্য দায়ী। তিনি বলেন,"এখানে নগরায়ন কমিউনিটিকে মাথায় রেখে হয়নি। ব্যক্তিকে মাথায় রেখে হয়েছে। ফলে একটি বাড়িতে একজন বয়স্ক মানুষ থাকেন। তার মৃত্যুর খবরও কেউ জানে না। কিন্তু যদি সেটা না হতো তাহলে মাঠ থাকত, ক্লাব থাকত। বচ্চারা খেলত। তার মাধ্যমেই সবার সঙ্গে সবার পরিচয় হতো। শহরে প্লট দিয়ে আলাদা বাড়ির ধারণা খুবই ভুল। যদি কমিউনিটি ভিত্তিক ফ্ল্যাট হতো তাহলে অল্প জায়গাই মাঠসহ সব কিছু থাকত। সবাই সবাইকে চিনত।”
সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা এবং অবিশ্বাসও বিচ্ছিন্নতার কারণ বলে মনে করেন সমাজ বিশ্লেষকেরা। এখানে মানুষের জন্য মানুষ এগিয়ে গেলে উল্টো বিপদে পড়তে হয়। তাই শহুরে মানুষ নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একা থাকছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও ল্যাঙ মারার সংস্কৃতি। তৌহিদুল হক মনে করেন," হয়তো এটাকে স্বাভাবিক বলে আমরা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু সমাজে এর অনেক ক্ষতিকর প্রভাব আরো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে।”
বাংলাদেশে ক্রমেই বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়বে। উন্নত চিকিৎসা, খাদ্য ও শিশু মৃত্যু কমে যাওয়ায় গড় আয়ু বাড়ছে। এখন দেশে প্রবীণের সংখ্যা দেড় কোটির বেশি। ২০৫০ সালে তাদের সংখ্যা হবে পাঁচ কোটি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড এ কে এম নূর-উন-নবী মনে করেন," এই প্রবীণদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা কাজে লাগানোর রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা এখনই নিতে হবে। প্রবীণরা এক সময়ে পরিবারে নাতি-নাতনি নিয়ে সময় কাটাতেন। এখন সেটা আর নেই। তারা নিঃসঙ্গ থাকেন। কিন্তু এখন যেহেতু গড় আয়ু বেড়ে গেছে, ভবিষ্যতে আরো বাড়বে তাই অবসরের পরও তার কর্মক্ষম থাকছেন। সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। এটাকে বলে পপুলেশরে রিডিভিডেন্ট। এক সময় বয়স্ক মানুষ আরো বেড়ে যাবে। তাই তাদের জন্য এখনই রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রয়োজন।”