বাংলা ছবির হাল ফিরবে?
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮বছরে ১২০ দিন বাধ্যতামূলক বাংলা ছবির প্রদর্শনী৷ অর্থাৎ, মাসে অন্তত ১০ দিন৷ পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র গোর্খা আঞ্চলিক প্রশাসনের আওতাভুক্ত জেলাগুলি বাদ দিয়ে সমস্ত সিনেমা হল এবং মাল্টিপ্লেক্সের জন্য এই নিয়ম চালু করছে রাজ্য সরকার৷ এতে হিন্দি, ইংরেজি সিনেমার দাপটে কোণঠাসা বাংলা সিনেমা তার বেঁচে থাকার জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাবে, এমনটাই আশা করা হচ্ছে৷এ কারণে চলচ্চিত্র নির্মাতারা, প্রযোজক এবং পরিচালক, দু'পক্ষই দু'হাত তুলে এই সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে৷ যাঁরা ছবি পরিবেশনার কাজে যুক্ত আছেন, তাঁরাও বলছেন এতে আখেরে বাংলা ছবির উপকারই হবে৷ কারণ, পশ্চিমবঙ্গের যে জেলাগুলি প্রতিবেশী রাজ্য বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের লাগোয়া, সেখানে হিন্দিভাষীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে সিনেমা হল বা মাল্টিপ্লেক্সে বাংলা ছবি দেখানো প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে৷ এর মধ্যে আসানসোল, দূর্গাপুরের বিস্তীর্ণ শিল্পাঞ্চলও আছে, যেখানে বাঙালি বাসিন্দার সংখ্যা নেহাত কম নয়৷ তার পরেও ওইসব শহরে বাংলা সিনেমা ব্রাত্য!
এমন নয় যে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম এমন এক ভাষাগত সিদ্ধান্ত নিল৷ ভারতের যে অংশে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি সবথেকে বড় এবং সচল, সফল, যেখানে আঞ্চলিক ভাষার প্রতি মানুষের টান অনেক জোরালো, সেই দক্ষিণ ভারতের দুটি প্রধান রাজ্য তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্রপ্রদেশে ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই যথাক্রমে তামিল এবং তেলুগু সিনেমার জন্যে এমন নিয়ম চালু আছে৷ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ঋদ্ধ মহারাষ্ট্রেও মারাঠি ভাষায় তৈরি ছবির জন্য এই একই নিয়ম বলবৎ৷ হিন্দি সিনেমা এবং হিন্দি ভাষার আগ্রাসন থেকে আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে বাঁচাতে এই নিয়মের সুফলও পাওয়া গেছে তিন রাজ্যেই৷ পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বাংলা ছবির জন্য এমন সংরক্ষণের তদ্বির করেও বিমুখ হতে হয়েছে৷ ডয়চে ভেলেকে জানালেন চিত্র পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়৷ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতিনিধিদের বলেছিলেন, ‘‘আমরা একটা অঙ্গরাজ্যে আছি, আমরা এটা করতে পারি নাকি! আমরা এটা করলে হলমালিকরা কোর্টে চলে যাবে, আমরা অপদস্থ হব! এসব আমাদের কাজ না৷ আমরা করব না৷ সেক্টারিয়ান আউটলুক নিয়ে আপনারা এসেছেন, এসব হয় না!’’ অনিকেত সেসময় সাংবাদিক, তখনও চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হননি৷ সাংবাদিক হিসেবেই বুদ্ধবাবুকে বলেছিলেন, অন্য রাজ্যে তো এরকম নিয়ম আছে৷ তাতে মুখ্যমন্ত্রীর জবাব ছিল, ‘‘ওসব গাজোয়ারি৷ আইন মেনে নয়৷’’
সেই প্রেক্ষিতে অনিকেত এখন আশ্বস্ত, যে বাংলা সিনেমা দেখানো বাধ্যতামূলক করার একটা আইনি সুযোগ তৈরি করল বর্তমান সরকার৷ এখন ‘‘একটা লিগাল প্রভিশন হলো৷ লিগালি আমরা এটা করতে পারি৷ সংরক্ষণ করতে পারি৷ সেইদিক থেকে এটা যুগান্তকারী,’’ বলছেন অনিকেত৷
কিন্তু এই সংরক্ষণে বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ কতটা উজ্জ্বল হবে, সেই নিয়ে সন্দিহান চিত্র সমালোচক, সাংবাদিক অনিরুদ্ধ ধর৷ বরং তাঁর রীতিমতো আপত্তি বছরে ১২০ দিনের এই বাধ্যতামূলক বাংলা ছবি দেখানোর নিয়ম নিয়ে৷ ডয়চে ভেলেকে অনিরুদ্ধ জানালেন, ‘‘আমার আপত্তি যেটা, যে এর ফলে যদি ভালো সিনেমা দেখানো হয় ওই ১২০ দিন, তা হলে আমার কোনো আপত্তি নেই৷ কিন্তু যেটা হবে, তেলা মাথায় তেল দেওয়া হবে৷ বাংলার যে সমস্ত বড় বড় প্রযোজক রয়েছেন কলকাতা শহরে, বা এই রাজ্যে, ঠিক এখন যেমন তাঁদের ছবিই কেবল দেখানো হয়, অন্য ছোট ছোট প্রযোজকের ছবি দেখানো হয় না, তাঁরা হল পায় না— এই জিনিসটা আরো বেশিভাবে হবে৷ ভালো বাংলা সিনেমা দেখানো হবে না৷’’
অনিরুদ্ধ ধর বলছেন, বাংলা চলচ্চিত্রে সেই উদাহরণ ভূরি ভূরি যে নতুন প্রযোজক, উদীয়মান পরিচালকের ভালো বাংলা ছবিকে জায়গা না দিয়ে দেখানো হয়েছে সেই সব মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবি, যার পিছনে আছে বড় ব্যানারের প্রযোজক সংস্থা, যাঁরা সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত৷ তবে এই মুহূর্তে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশেরই মত, দেখাই যাক না, এর পর বাংলা ছবির স্বার্থে আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়! সংরক্ষণের কোনো আইনই ছিল না, এখন অন্তত সেটা হলো৷ এবার কীভাবে সেই আইনের সুবিধে নেওয়া যায়, সেটা নিয়ে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই ভাবনাচিন্তা করা হবে৷ কাজেই সময়ই বলবে, বাংলা ছবিকে বাঁচাতে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখানো হলো কিনা৷