হাসপাতালই করোনার বড় উৎস?
২৭ এপ্রিল ২০২০হাসপাতালগুলো লকডাউন হওয়ার তিনটি কারণকে প্রাধান্য দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা৷ সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালের পরিস্থিতি বেশি খারাপ বলে তারা জানান৷ বেসরকারি কোনো কোনো হাসপাতালে চিকিৎসকদের পিপিই পরতে দেয়া হয় না বলেও অভিযোগ আছে৷ ওইসব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মনে করে, চিকিৎসকরা পিপিই পরলে রোগীরা ভয় পান৷
সার্বিকভাবে হাসপাতালের এই পরিস্থিতির প্রধান তিনটি কারণ হলো, ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, নিম্ন মানের পিপিই এবং এবং রোগীদের তথ্য গোপন করার মানসিকতা৷ আবার পিপিই থাকলেও অনেক চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী এর সঠিক ব্যবহার জানেন না৷
হাসপাতাল লকডাউন
গত ২৩ এপ্রিল ঢাকার বারডেম হাসপাতালের আইসিইউ লকডাউন করে আইসিইউর সব চিকিৎসক ও নার্সকে হোম কোয়ারান্টিনে পাঠানো হয়৷ হাসপাতালের আইসিইউতে এক রোগী করোনা ভাইরাসের লক্ষণ গোপন করে ভর্তি হয়েছিলেন৷ আর তার ফলাফল হলো আইসিইউতে থাকা সাত রোগীই এখন করোনায় আক্রান্ত৷ এ কারণে আইসিইউ লাকডাউন করে সেখানকার সব চিকিৎসক ও নার্সকে হোম কোয়ারান্টিনে পাঠাতে বাধ্য হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ৷
এর আগে ৯ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের একটি ইউনিট লকডাউন করা হয়৷ ওই ইউনিটে চিকিৎসাধীন একজন করোনায় মারা গেলে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়৷
ইনসাফ বারাকাহ নামের একটি বেসরকারি কিডনি হাসপাতাল লকডাউন করা হয় ১৪ এপ্রিল৷ চিকিৎসক-নার্সসহ ৯ জন করোনা আক্রান্ত হওয়ায় এই ব্যবস্থা নিতে হয়৷
এছাড়া ঢাকার আনোয়ার খান ও ল্যাবএইডসহ বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল আংশিক লকডাউন করা হয়৷ সর্বশেষ আংশিক লকডাউন করা হয়েছে বিআরবি হাসপাতাল৷
ঢাকার বাইরে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতাল লকডাউন করা হয় ২৬ এপ্রিল৷ এর বাইরে কয়েকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সও লকডাউন করা হয়েছে৷ তবে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কতগুলো হাসপাতাল পূর্ণ বা আংশিক লকডাউন হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে৷ বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ)-এর হিসেবে ঢাকায় সাতটি এবং ঢাকার বাইরে দুটি হাসপাতাল এ পর্যন্ত আংশিক ও পুরো লকডাউন করা হয়েছে৷
আক্রান্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসেসিয়েশন (বিএমএ)-এর মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী সরকারি হিসেব উল্লেখ করে জানান, সোমবার পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৬৪৪ জন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন৷ এরমধ্যে চিকিৎসক ২৮৯ জন৷ ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে৷ ঢাকা বিভাগের ঢাকায় ১২৩ জন, কিশোরগঞ্জে ৫৩, গাজীপুরে ১৪, নারায়ণগঞ্জে ১৪, নরসিংদীতে ৪, মানিকগঞ্জে ২, মাদারীপুরে ২ এবং গোপালগঞ্জে ১ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন৷ সারাদেশে মোট নার্স আক্রান্ত হয়েছেন ১১২ জন৷ ঢাকা বিভাগেই বেশি৷ এর বাইরে অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন ২৪৩ জন৷
তবে বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন(বিডিএফ)-এর প্রধান সমন্বয়কারী ডা. নিরুপম দাস এই সংখ্যার সাথে ভিন্নমত পোষন করেন৷ তিনি বলেন ‘‘আমরা যে তথ্য সংগ্রহ করি নিয়মিত, তাতে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত ৩৭৩ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন৷ মারা গেছেন একজন৷ সুস্থ হয়েছেন আট জন৷ নার্স আক্রান্ত হয়েছেন ২২০ জন৷ সুস্থ হয়েছেন ছয় জন৷
‘বাকি পিপিই কোথায় গেল?'
চিকিৎসকরা প্রধানত নিম্নমানের পিপিই'র কারণে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানান বিএমএ'র সাবেক মহাসচিব এবং স্বাচিপ-এর সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সালান খান৷ তিনি বলেন, ‘‘এর সঙ্গে আছে পিপিই ব্যবহার করতে না জানা৷ মান সম্পন্ন পিপিই থাকলেও তা ব্যবহারের নিয়ম না জানলে কোনো লাভ নেই৷ এ নিয়ে আমাদের চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের আগে থেকেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি আগে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সামাজিক স্টিগমার কারণে অনেক করোনা আক্রান্ত তার লক্ষণ গোপন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন৷ এ কারণে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হয়েছেন৷ হাসপাতাল লকডাউন করতে হয়েছে৷''
বিএমএ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘এখন প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার পর ভালো পিপিই বিতরণ হচ্ছে৷'' তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত এক লাখ ১০ হাজার মানুষের মধ্যে ১৩ লাখ পিপিই বিতরণের কথা বলা হয়েছে৷ তাহলো তো গড়ে ১৩টা করে পিপিই পাওয়ার কথা৷ কিন্তু পিপিই'র তো এখনো সংকট আছে৷ ওই পিপিইগুলো তাহলে কোথায় গেল?''
তিনি বলেন, ‘‘ব্র্যাক ইউনিভার্সিাটর জরিপে দেখা গেছে, এখানো ২৫ ভাগ চিকিৎসক পিপিই পাননি৷ ৪০ ভাগ নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী এখনো পিপিই পাননি৷''
ডা. নিরুপম দাস এর সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবং অধিক সংখ্যক চিকিৎসককে একসঙ্গে কাজে লাগানোর কারণে তারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন৷ আগে থেকে পরিকল্পনা না থাকায় এটা হয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আর বেসরকারি হাসপাতালে তো পিপিই দেয়া হয় না৷ নিজেদের কিনে নিতে বলে৷ করোনায় আক্রান্ত হলে তারা, লকডাউন করতে চায় না, কারণ তাহলে অন্য রোগী পাবে না৷ এমনকি কোনো কোনা বড় প্রাইভেট হাসপাতাল চিকিৎসকদের পিপিই পরতে দেয় না৷ পিপিই পরলে রোগী ভয় পাবে এবং কমে যাবে বলে তারা মনে করে৷ তারা তাদের ব্যবসা দেখছে৷ আবার রোগী কম দেখিয়ে হাসপাতাল চালু রেখে প্রণোদনাও আদায়ের চেষ্টা করে৷''
রোগীরা তাদের করোনা উপসর্গ লুকিয়ে হাসাপাতালে চিকিৎসা নিতে যায়, কারণ, উপসর্গের কথা বললে কোনো হাসপাতাল তার চিকিৎসা করবে না এমন একটা ভয় থাকে৷ একারণে শুরুতেই চিকিৎসায় টায়ার সিস্টেম থাকার দরকার ছিল৷ সবাইকে করোনা রোগী ধরে তারপর প্রাথমিক পরীক্ষার মাধ্যমে ভাগ করে ফেললে এই সমস্যা হতো না বলে মনে করেন ডা. এহতেশাম৷
তিনি বলেন, ‘‘গবেষণায় দেখা গেছে, উহানে ৪০ ভাগ করোনা ছড়িয়েছে হাসপাতাল থেকে৷ আমাদের এখানেও তা-ই হচ্ছে৷ চিকিৎসক আক্রান্ত হচ্ছেন, হাসপাতাল লকডাউন হচ্ছে৷ এখন হাসপাতালই করোনা ভাইরাসের বড় সোর্সে পরিণত হচ্ছে৷ এটা জরুরিভাবে মোকাবেলা করা দরকার৷''
তাঁর মতে, ‘‘করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের আক্রান্তের হার কম৷ সেটা বিবেচনায় নিয়ে সব হাসপাতালেই একই ধরনের ব্যবস্থাপনা চালু করা যায়৷''