জনসংখ্যা এবং দুর্নীতি ক্রমবর্ধমান
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬প্রথম দু'টি সত্যি বিশ্বের সব দেশে এবং বাকি দু'টি শুধু বাংলাদেশের মতো কিছু দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য৷ ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে' – এ দাবি সব সরকারই করতে পেরেছে, ‘দেশ আগে দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিল, এখন নেই' – এমন দাবিও আমরা শুনেছি৷ কিন্তু ‘বাংলাদেশে কখনো দুর্নীতি ছিল না' – এমন কথা কেউ বলেছেন বলে আমার জানা নেই৷ এমনটি বললে বক্তার ‘নিরপেক্ষতা' এবং ‘মানসিক সুস্থতা' নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে৷
বাংলাদেশে কোন শাসনামলে দুর্নীতি ছিল না? হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকা, একটি টেলিভিশন চ্যানেল আর একটি মাত্র বেতারকেন্দ্রেও যখন সব খবর, সব নাম প্রচার করা যেতো না – তখনকার অবস্থাটা বিবেচনায় নিয়ে বেশি কথা বলার তেমন কোনো মানে হয় না৷ সামরিক শাসনের সময় বা জলপাই রঙের ছায়াশোভিত গণতান্ত্রিক আমলে কিভাবে সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো – তা তো আমরা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলের কথা পড়ে আর শুনেই অনুমান করতে পারি৷ তখনকার সাংবাদিকদের স্মৃতিচারণামূলক অনেক লেখা তো এখনো অনলাইনে, বইয়ের দোকানে আছে৷ এখনো তো প্রতি রাতে কত টক শো হচ্ছে, শুনলে দেখা যাবে কোনো-না-কোনোটিতে অবধারিতভাবেই চলে এসেছে সেই সময়ের সাংবাদিকদের ডিজিএফআই-এর টেলিফোন আতঙ্কের কথা৷
তবে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ এবং ১৯৯০ থেকে ২০১৫ – এই দুই সময়কালকে মাথায় রেখে দেশে দুর্নীতি ছিল কিনা, থাকলে কতটা ছিল – এমন আলোচনা হতেই পারে৷ ‘‘বঙ্গবন্ধু ‘বাকশাল' দিয়ে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন, তখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও ক্ষুণ্ণ হয়েছিল' – এ সব বলে ওই সময়ের দুর্নীতির চিত্র বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরা নিয়ে কোনো কোনো মহল সংশয় প্রকাশ করতে পারেন৷ তাঁদের শুধু বঙ্গবন্ধুর একটি উক্তি মনে করিয়ে দিই৷ বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের দিকে বিদেশি সাহায্যের কম্বল নিয়ে ‘হরির লুটের' কথা জেনে প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষের কম্বল এলো, আমার কম্বল গেল কই?' বঙ্গবন্ধু বেপরোয়া দুর্নীতিপরায়নদের শায়েস্তা তো দূরের কথা, নিয়ন্ত্রণও করতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন, তা না হলে নিশ্চয়ই এমন মন্তব্য তাঁর মুখে শুনতে হতো না৷
'৭৫-এর পর থেকে রাজনীতিতে টাকা এবং টাকাওয়ালাদের প্রভাব নিরবচ্ছিন্নভাবে বেড়েছে৷ সাবেক প্রেসিডেন্ট, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এক সাক্ষাৎকারে দেশ এবং রাজনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন ‘মানি ইজ নো প্রবলেম' এবং ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ান্স'৷ বাংলাদেশ ‘শহিদ জিয়ার' আমল থেকেই বিচারপতি সাত্তার, ‘পল্লিবন্ধু' এরশাদ, ‘দেশনেত্রী' খালেদা জিয়া এবং ‘জননেত্রী' শেখ হাসিনার আমল মিলিয়ে বেশ কয়েকটি শাসনামল দেখেছে৷ সব আমলেই তৃণমূল থেকে উঠে আসা ‘প্রকৃত' রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন হয়েছে, তাঁদের সংখ্যা ক্রমাগত কমেছে এবং বেশির ভাগ ‘উল্লেখযোগ্য' রাজনীতিবিদের জন্যই ‘মানি' কোনো ‘প্রবলেম' থাকেনি৷
একটা দেশের দুর্নীতির অভয়াঞ্চল হয়ে উঠতে এরপর আর তেমন কিছুর দরকার পড়ে না৷ রাজনীতি রাজনীতিবিদদের জন্য ধীরে ধীরে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে হয়ে এখন কঠিনতম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে৷ অন্যদিকে ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত আমলা – বলতে গেলে সব পেশাজীবীই ঢুকে পড়েছেন রাজনীতিতে৷ অন্য পেশা থেকে যাঁরা এসেছেন তাঁদের বেশির ভাগই এসেছেন মূলত ‘রাজনীতিতে অর্থ উপার্জন কোনো সমস্যাই নয়' – এই সত্যিকে মন্ত্রজ্ঞান করে৷ তাঁদের প্রায় সবারই ‘সিদ্ধিলাভ' হয়েছে৷ ক্ষমতায়, ক্ষমতার দৌড়ে বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার কারণে নানান অপকৌশলে তাঁরা টাকা রোজগার করেছেন৷ খুব গরিব মানুষ নেতা হয়ে নিজের দলে কদর পাচ্ছেন এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব৷
‘বাইরের লোক' রাজনীতিতে এসে শুধু রাজনীতিকে কলুষিত করেননি, যে পেশা থেকে এসেছেন সেই পেশাও তাঁদের মাধ্যমে কলুষিত, দুর্নীতিগ্রস্থ হয়েছে৷ একজন ব্যবসায়ী সরকারি দলে যোগ দিয়ে টাকার পাহাড় গড়ে ব্যবসায়ী সমাজে ‘অনুকরণীয়' দৃষ্টান্ত হয়ে যাচ্ছেন৷ তাঁকে অনুসরণ করে অন্য ব্যবসায়ীরাও টাকার পাহাড় গড়ার সহজ ফর্মুলাই রপ্ত করছেন৷
সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষকদের হাত ধরেও রাজনীতির অঙ্গনসহ পুরো দেশটা এভাবেই দুর্নীতিগ্রস্থ হয়েছে৷ রাজনীতিবিদরা আপোষকামি না হলে অন্য পেশাজীবীদের জন্য রাতারাতি ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া' নিশ্চয়ই কঠিন হতো৷ পোড় খাওয়া অনেক রাজনীতিবিদই নীতি, আদর্শের প্রশ্নে আপোষহীন না হয়ে বরং গড্ডালিকপ্রবাহেই গা ভাসিয়েছেন৷ রাজনীতির নেতার চেয়ে তাঁরা অনেকক্ষেত্রে দুর্নীতির বড় নেতা হয়ে গেছেন৷ সমাজের আগাপাশতলা এভাবেই এখন এ সব দুর্নীতিপরায়নের লেজ ধরে ধরেই দুর্নীতিগ্রস্ত৷ বাংলাদেশে জনসংখ্যাবৃদ্ধি কখনো থামেনি, দুর্নীতিও কমেনি৷ দু'টোই বাড়ছে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷