বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জীবন
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশে এই রোহিঙ্গাদের বসবাস৷ তাঁদের অধিকাংশই মুসলিম৷ ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়রিতে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর সেখানকার পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল৷ সরকারের উচ্চ পদেও তাঁদের দেখা গেছে৷ কিন্তু ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করার পর থেকে নিজ দেশে পরবাসী হয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা৷ সামরিক সরকার তাঁদের ‘বিদেশি' হিসেবে অভিহিত করে নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়৷ শুরু হয় তাঁদের উচ্ছেদ এবং নির্মূল করার প্রক্রিয়া৷ নে উইন তাঁদেরকে দমনের জন্য দুই দশকব্যাপী সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন৷
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ১৯৭৮ সালে নাগামান ( ড্রাগন রাজা) নামে এক অভিযান চালায় রাখাইন প্রদেশে৷ সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের ফলে তখন মুসলিম রোহিঙ্গারা সেখান থেকে পালাতে শুরু করে৷ তখন প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে৷
কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং অনিবনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের চেয়ারম্যান আবু সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘নে উইন ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই আমাদের ওপর দুর্যোগ নেমে আসে৷ নাগরিকত্ব বাতিলের পর বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়, যাতে রোহিঙ্গারা সংখ্যায় বাড়তে না পারে৷ আমাদের জাতিপরিচয় মুছে ফেলার তৎপরতা ছিল সার্বক্ষণিক৷ আমরা রোহিঙ্গা৷ কিন্তু আমাদের কখনো নাম দেয়া হয়েছে ‘কোলা ব্যাঙ', কখনো রোহাং আর কখনো রাখাইন৷ মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর সংসদে আমাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল৷''
১৯৭৮ সালে মিয়ানমারে অবৈধভাবে বসবাসরত ‘বিদেশি' নাগরিকদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো হয়৷ কিন্তু মূল টার্গেট ছিল মুসলিম রোহিঙ্গা বিতাড়ন৷ এরপর ১৯৯১-৯২ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ধর্মীয় দাঙ্গার শিকার হন রোহিঙ্গা মুসলমানরা৷ এরপর ২০১২ সালে আবারও দাঙ্গার শিকার হন রোহিঙ্গারা ৷ আর সর্বশেষ গতবছরের অক্টোবর মাস থেকে চলছে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন৷
কক্সবাজারের অনিবন্ধিত লেদা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান দুদু মিয়া রাখাইনের মংডু জেলা থেকে বাংলাদেশে আসেন ২০০৩ সালে৷ তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন৷ ডয়চে ভেলেকে দুদু মিয়া বলেন, ‘‘আমরা অংসান-এর শাসনামল পর্যন্ত ভালো ছিলাম৷ এরপর নে উইনের সময় আমাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়৷ আমাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র ছিল৷ পরে তা কেড়ে নিয়ে সাদা রংয়ের এক ধরণের পরিচয়পত্র দেয়া হয়৷ আর তাতে আমাদের বাংলাদেশি নাগরিক বলে উল্লেখ করা হয়৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘১৯৯২ সালের পর থেকে অন্তত ৬ বার আমাদের ওপর প্রকাশ্যে অভিযান চালানো হয়৷ প্রতিবারই শত শত রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়৷ নানা সময়ে আমাদের ভূমির অধিকার কেড়ে নেয়া হয়৷ ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়৷''
‘রোহিঙ্গা ও নগারিকত্ব' বিষয়ক গবেষক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউর রহমান লেনিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তিনশ' বছরেরও বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গরা মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের বাসিন্দা৷ যে আরাকান এখন রাখাইন রাজ্য নামে পরিচিত৷ ব্রিটিশ কলোনির সময় রোহিঙ্গারা ওই এলাকায় ছিলেন৷ ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বিতর্কিত সিটিজেনশিপ আইনের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে পুরোপুরি অস্বীকার করে৷''
রেজাউর রহমান লেনিন আরো বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি আলাদা বলেই মনে হয়৷ মিয়ানমারে ১৩৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আছে৷ কিন্তু রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেয়া হয় না৷''
এ প্রসঙ্গে দুদু মিয়া বলেন, ‘‘আমাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়না , কারণ, আমরা মুসলমান৷ সেখানে বৌদ্ধরা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছে৷''
২০১৫ সালের নির্বাচনে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী নেত্রী অং সান সু চি ক্ষমতায় আসেন৷ আশা করা হয়েছিল রোহিঙ্গাদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি থাকবে৷ কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ তিনিও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক মনে করেন না৷ তবে গত বছর ৯ সদস্যের রাখাইন কমিশন বা কফি আনান কমিশন গঠন করা হয়৷ তাঁরা এক বছর সময় নিয়ে কাজ করছেন৷ তাঁদের প্রতিবেদনের পর কী হয় তা দেখার অপেক্ষায় আছেন রোহিঙ্গারা৷
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রেজিস্টার্ড ক্যাম্প দু'টি৷ কক্সবাজারের কুতুপালং ও নয়াপড়া ক্যাম্প৷ এই দু'টি ক্যাম্পে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করেন৷ এছাড়া লেদা ও কুতুপালং এলকায় আরো কয়েকটি আনরেজিষ্টার্ড ক্যাম্প আছে৷ রোহিঙ্গা শরণার্থী নেতা দুদু মিয়া বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এখন কমপক্ষে চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে৷ এক সময় আরাকানে ৪০ লাখ রোহিঙ্গা ছিল, এখন আছে আট লাখ৷ নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ও উচ্ছেদের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ ছাড়াও সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও অষ্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর আরো অনেক দেশে ছড়িয়ে পরেছে৷''
গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমার সীমান্ত চৌকিতে আক্রমনে মিয়ানমারের ৯ পুলিশ নিহত হয়৷ এই ঘটনায় সাত হামলাকারীও নিহত হয়৷ এরপর মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ চালায়৷ ৯ অক্টোবরের পর মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী রাখাইন প্রদেশে মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপর হামলা শুরুর পর থেকে শতাধিক নিহত ও হাজার হাজার রোহিঙ্গা গৃহহারা হয়েছে৷ এর মধ্যে প্রায় ৭০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে৷
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘বিচ্ছিন্নতাবদী ও সন্ত্রাসী' কার্যকলাপের অভিযোগ আছে মিয়ানমারের৷ ৯ অক্টোবরের হামলার জন্য মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দায়ী করছে৷ অন্যদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘আকামুল মুজাহিদীন (এএমএম)' নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার খবরও পাওয়া যাচ্ছে৷ এছাড়া সেখানে রোহিঙ্গা সলিডাটিরি অর্গানাইজেশন, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স, আরাকান রিপালিকান আর্মিসহ নানা সশস্ত্র সংগঠনের নাম শোনা যায়৷
কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর বছরের পর বছর ধরে যে নির্যাতন-নিপীড়ণ চলছে তা গণহত্যার মতো বলে মনে করে জাতিসংঘ৷ রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে হত্যার শিকার হচ্ছেন৷ কেউ জঙ্গলে পালিয়ে আছেন৷ কেউবা পালাতে গিয়ে নদীতে ডুবে মারা যাচ্ছেন৷ আর যাঁরা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আছেন, তাঁদের মধ্যে রেজিষ্টার্ড রোহিঙ্গারা কিছু সহায়তা পান, বাকিরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন৷
সর্বশেষ নির্যাতনের শিকার হয়ে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের কেউ কেউ ভিক্ষা করতেও বাধ্য হচ্ছেন৷
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া কফি আনান কশিনের সদস্যরা বলেছেন, ‘‘মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা ৮০ শতাংশ নারী মিয়ানমারেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷''
বাংলাদেশ সরকার বরারই এখানে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবি করে আসছে৷ আর ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত তাঁদের কক্সবাজার থেকে সরিয়ে নোয়াখালীর ঠ্যাঙ্গার চরে রাখতে চাইছে৷ রোহিঙ্গা শরণার্থী আবু সিদ্দিক বলেন, ‘‘বাংলাদেশ আমাদের জন্য আর কত করবে? আমারা আমাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷