বাংলাদেশে ভারতীয় অবৈধ অস্ত্রের বাজার
১৬ নভেম্বর ২০২১গত ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার গাবতলী থেকে একটি প্রাইভেটকারসহ পাঁচজনকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ। তাদের কাছ থেকে ম্যাগাজিন ও গুলিসহ আটটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ভারতীয় অবৈধ অস্ত্রের বাংলাদেশে চোরাচালান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, আটকদের কাছ থেকে পাওয়া ফোন নম্বর দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কল করে ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলেছেন গোয়েন্দারা। তারা গোয়েন্দাদের বলেছেন,"যত প্রয়োজন তত অস্ত্র দেয়া যাবে৷”
ভারত থেকে যেসব অস্ত্র আসে তা ওয়েল ফার্নিসড বলে জানান গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান। তিনি বলেন,"এসব আগ্নেয়াস্ত্র বাংলাদেশে সর্বনিম্ন ৮০-৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। যে চক্রটি বাংলাদেশে এই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা করে তারা ২০১৪ সাল থেকে ভারত থেকে অস্ত্র আনছে। আটকদের একজন আকুল হোসেন যশোরের ছাত্রলীগ নেতা। তাদের সবার বাড়ি যাশোর এলাকায়।”
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, যশোর সীমান্ত দিয়েই প্রধানত ভারতীয় অস্ত্র আসে। বোনাপোল সীমান্তের কাছে পুটখালী নামে একটি গ্রাম আছে। তার অপর দিকে ভারত। ভারতের ওই এলাকায় কমপক্ষে তিনজন অস্ত্র ব্যবসায়ী আছে যারা বাংলাদেশে অস্ত্র পাঠায়। ভারতে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে অবৈধ অস্ত্রের কারখানা আছে।
কীভাবে পাঠায়?
গোয়েন্দারা জানান, সীমান্তের ওপারে ভারতীয় গ্রামগুলোতে খড়ের গাদা, মাটির গর্ত, পুকুরের মধ্যে পলিথিন নিয়ে সুরক্ষিত করে অস্ত্র জমিয়ে রাখা হয়। এর পর সুযোগ বুঝে সীমান্তের গ্রামগুলোতে যারা ফসলের ক্ষেতে কাজ করেন তাদের মাধ্যমে কাঁটাতারের বেড়ার এপাশে একটি একটি করে অস্ত্র পাঠানো হয়। বাংলাদেশে যারা সেগুলো গ্রহণ করে তারও সীমান্ত এলাকায় খড়ের গাদা, মাটির গর্ত বা পুকুরের মধ্যে প্লাস্টিক মুড়িয়ে লুকিয়ে রাখে। এরপর চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। এই অস্ত্র যশোর ও খুলনা হয়ে দেশের বিভিন্ন এলকায় চলে যায়। যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা ঢাকায় অস্ত্র বিক্রি করতে এসেছিলো। পরিবহনের জন্য তারা প্রাইভেট কার ছাড়াও যাত্রীবাহী বাস, মোটর সাইকেল ব্যবহার করে।
কারা কেনে?
এইসব অস্ত্রের চাহিদা রয়েছে মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, অবৈধভাবে জমি দখলকারী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কাছে। নির্বাচনের সময়ও এই অস্ত্রের চাহিদা বাড়ে। এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময়ও এই অস্ত্রের চাহিদা বেড়েছে বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ছাত্রলীগ নেতা আকুল হোসেন ও তার সহযোগীরাও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং তারাও মাদক ব্যবসা, পুরাকীর্তি পাচার ও জমিদখলসহ আরো অনেক অপকর্মে জড়িত। ক্ষমতা থাকার পরও কেন অস্ত্রের প্রয়োজন হয়? গোয়েন্দাদের এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেছে,"অস্ত্র থাকলে লোকজন ভয় পায়। আর অস্ত্র নানা মহলের সাথে যোগাযোগ তৈরিতে সহায়তা করে।”
কত চক্র?
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে ভারতীয় অস্ত্র চোরাচালানের যশোর ও খুলনা ভিত্তিক অন্ততঃ পাঁচ-ছয়টি চক্র আছে। এই চক্র গুলো আবার পারস্পরিক যোগাযোগ রাখে। আবার স্বার্থের দ্বন্দ্ব হলে একটি চক্র আরেকটি চক্রের তথ্য ফাঁস করে দেয়। গোয়েন্দা বিভাগের হাতে যে চক্রটি ধরা পড়েছে তারা ২০১৪ সাল থেকে দুইশরও বেশি অস্ত্র ভারত থেকে আনার কথা স্বীকার করেছে। তারা শুধু পিস্তল নয়, রিভলবার ও বন্দুকও আনে। গুলিও ভারত থেকে আসে। প্রতিটি গুলি বাংলাদেশে বিক্রি হয় ১১-১২শ' টাকায়। চাহিদার ওপর নির্ভর করে আগাম অর্ডারের ভিত্তিতে তারা এইসব অস্ত্র আনে। বেনাপোল বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুন খান জানান, এর আগে তারা কয়েকটি চক্রের সদস্যদের ভারতীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছেন । তবে তারা ছিলো ক্যারিয়ার। তাদের কাছ থেকে মূল অস্ত্র ব্যবসায়ীদের নাম তারা জানতে পারেননি। তিনি জানান," ঢাকায় আটক আকুল হোসেন এর আগেও ধরা পড়েছিল। তার নামে ২০১৭ সালের আগে কয়েকটি মামলা হয়েছে।”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সীমান্ত এলাকা দেখার দায়িত্ব বিজিবির । ওখানে আমরা যেতে পারি না। যারা সীমান্ত পার হয়ে ভিতরে চলে আসে অস্ত্রসহ তাদের কেউ কেউ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।
গোয়েন্দারা জানান, যশোর ছাড়া নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ কেন্দ্রিকও ভারতীয় অস্ত্র চোরাচালান চক্র আছে। আর বান্দরবান ভিত্তিক গ্রুপগুলো অস্ত্র আনে মিয়ানমার থেকে।
বিজিবি গত বছর বিভিন্ন সীমান্ত থেকে ১০০টি বন্দুক, ৩৩টি পিস্তল, একটি রিভলবার, ৩৫টি ম্যাগাজিন, ১০ হাজার ৪৭৩টি গুলি ও গোলাবরুদ এবং দুই কেজি ২০০ গান পাউডার উদ্ধার করেছে।
চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ৩৬টি পিস্তল, চারটি রিভলবার ও ৪৩টি বন্দুক উদ্ধার করা হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান,"তিনজন ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীর নাম ও ঠিকানা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ভারতীয় পুলিশকে পাঠানো হয়েছে। তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা আমরা এখনো জানতে পারিনি। তবে আশা করছি তারা ব্যবস্থা নেবেন।”
"কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান বন্ধ সম্ভব নয়”
বিজিবির যশোর অঞ্চলের (৪৯ বিজিবি) কমান্ডার লে. কর্নেল সেলিম রেজা জানান, তারা অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান রোধে সবোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছেন। তারপরও দুই-একটি অবৈধ অস্ত্র আসছে। তিনি বলেন,"যশোর অঞ্চলে ভারতের সাথে সীমান্ত ৭০ কিলোমিটার। এরমধ্যে ৫৬ কিলোমিটারে কাঁটাতারের বেড়া আছে। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া কেনো সময় অস্ত্র চোরাচালান বন্ধ করতে পারে না। অস্ত্র চোরাচালনের সাথে বড় চক্র জড়িত থাকে। তাদের চোরাচালান প্রবণতা অব্যাহত আছে।”
তার মতে," যশোর সীমান্তের পাশে ইছামতিসহ আরো কয়েকটি ছোট ছোট জায়গা আছে সেখান থেকে মাঝেমধ্যে দুই-একটি অস্ত্র আসে। আমরা যখন ধরি তখন বুঝতে পারি। আমরা নিয়মিত ও বিশেষ টহলের পাশাপাশি জিজিবির নিজস্ব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি।”