সীমান্ত হত্যা, চোরাচালান, বাস্তবতা
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬গরু চোরাচালানের কারণে সীমান্ত হত্যা হচ্ছে – এই তত্ত্বটিও আর টিকেছে না৷ কারণ ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু চোরাচালান প্রায় বন্ধ হয়ে গেলেও, সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি৷
‘কমেছে গরু পাচার, বেড়েছে সীমান্ত হত্যা' – গত ১ ডিসেম্বর খবরটি দেয় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস৷ খবরে বলা হয়, ‘গত বছরের এপ্রিল মাসে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশে ভারত থেকে গরু পাচার বন্ধের নির্দেশ দেয়ার পর, সাত মাসে গরু চোরাচালান শতকরা ৭০ ভাগ কমে গেছে৷ কিন্তু বিপরীতে সীমান্ত হত্যা না কমে বরং বেড়েছে৷ রাজনাথ সিং-এর ঘোষণার পর ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর গুলিতে ২৪ জন গরু পাচারকারী নিহত হয়েছেন৷ আগের বছর, ২০১৪ সালে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ১০ বাংলাদেশি৷'
২০১১ সালে বিএসএফ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়া মানুষদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তি স্বাক্ষর করে৷ এ চুক্তির পরবর্তী কয়েকবছর সীমান্ত হত্যা কমে আসলেও, এখন আবার তা বাড়ছে৷ গত তিন বছরের পরিসংখ্যানও বলছে সে'কথাই৷
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে, গত তিন বছরে বিএসএফ-এর হাতে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বেড়েছে৷ এই হত্যাকাণ্ডগুলি ঘটছে গোলাগুলি ও নির্যাতনের কারণে৷ তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা৷ এদের মধ্যে ১২ জনকে গুলি করে এবং ১৪ জনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়৷ বাকি একজনকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তা জানা যায়নি৷
এরপর ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে৷ এরমধ্যে গুলি ও নির্যাতনে সমান সংখ্যক বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়৷ গত বছরে হত্যা করা হয়েছে ৪২ জনকে, আহত হয়েছেন ৬৮ জন৷ এছাড়া বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে ৫৯ জনকে৷ গত তিন বছরে সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যায় ২০১৫ সাল শীর্ষে অবস্থান করছে৷ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিএসএফ হত্যা করেছে তিনজন বাংলাদেশিকে৷
তবে আরো একটি চিত্র আছে৷ আর তা হলো, বাংলাদেশ-ভারত সীমেন্ত বিএসএফ শুধু বাংলাদেশিদেরই হত্যা করছে না, তাদের হাতে সীমান্ত এলাকায় ভারতের বাঙালিরাও নিহত হচ্ছেন৷ ভারতের মানবাধিকার সংগঠন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)-এর প্রধান কিরীটি রায় জানান, ‘‘ভারতীয় নগরিকরাও বিএসএফ-এর হাতে নিহত হচ্ছেন৷ গত এক বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে যে ২৫ জন ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন, তারা বাঙালি৷ পুরো সীমান্তের হিসাব করলে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে৷''
এরসঙ্গে আরেকটি তুলনামূলক চিত্র বেশ অবাক হওয়ার মতো৷ তা হলো – তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে মোট ১০২ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হলেও, একই সময়ে পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে ৪৬ জন পাকিস্তানি নাগরিক নিহত হয়৷ নিহত পাকিস্তানি নগারিকদের বড় একটি অংশ সামরিক এবং আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য৷ তবে বাংলাদেশের নিহত নাগরিকরা সবাই নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ৷
সীমান্তে বাংলাদেশি ফেলানী হত্যার সরকারি কৌঁসুলি আব্রাহাম লিংকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে যে, সীমান্তে বিএসএফ বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে শত্রু রাষ্ট্রের চেয়েও খারাপ আচরণ করছে৷''
আসক-এর পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এতদিন গরু চোরাচালানকে সীমান্ত হত্যার কারণ হিসেবে বলা হতো৷ কিন্তু এখন তো গরু চোরাচালান বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়৷ তারপরও সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বাড়ছে৷ আসলে সীমান্ত হত্যার পিছনে আসল কারণ হলো ভারতের মনোভাব৷ ভারত কাশ্মিরসহ পাকিস্তান সীমান্তে নিয়োজিত বিএসএফ সদস্যদের এখনো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়োগ করে৷ তাদের অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী নয়৷ তাদের মনোভাব যুদ্ধংদেহী৷ ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না৷''
বিএসএফ-এর দেওয়া তথ্য অনুসারে, ভারত থেকে ২০১৩ সালে ২২ লাখ গরু বাংলাদেশে পাচার হয়৷ ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৮ লাখে৷ আর ২০১৫ সালে পাচার হওয়া গরুর সংখ্যা সাড়ে চার লাখ৷
আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘‘আসলে গরু চোরাচালান নয়, মূল বিষয় হলো মানসিকতা৷ মানসিকতার পরিবর্তন না হলে সীমান্ত হত্যা কমবে না৷ সীমান্তে দুই দেশের মানুষেরই কিছু সাধারণ বিষয় আছে৷ তাই সীমান্ত হাটগুলো সত্যিকার অর্থে কার্যকর করতে হবে৷ তাছাড়া সীমান্তে চোরাচালান বন্ধে বাংলাদেশকেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে৷ ভারতকে বুঝতে হবে যে, সীমান্ত হত্যা সীমান্তে জঙ্গি তৎপরতা উসকে দিতে পারে, যা দু'দেশের জন্যই অকল্যাণকর৷''
আব্রাহাম লিংকনের কথায়, ‘‘মানবাধিকার কী – সেটা সীমান্তরক্ষীদের বুঝতে হবে৷ কিন্তু তারা শুধুই যুদ্ধ বোঝেন৷''
আর নূর খানের কথায়, ‘‘দু'দেশের শীর্ষ পর্যায়ে সীমন্ত হত্যা নিয়ে আরো বৈঠক হওয়া প্রয়োজন৷ দুই দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য সত্যিকার অর্থেই সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে৷''
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, যা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্থল সীমান্ত৷ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে৷ শুধু পশ্চিমবঙ্গের সাঙ্গেই ২,২১৭ কিমি. সীমান্ত আছে বাংলাদেশের৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷