গরমে পুড়ছে পশ্চিমবঙ্গ!
৭ এপ্রিল ২০১৪৩০শে মার্চ রবিবার কলকাতাসহ গোটা গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে তাপমানযন্ত্রের পারদ ছুঁয়েছিল ৩৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস! মানে স্বাভাবিকের থেকে প্রায় ৬ ডিগ্রি বেশি৷ সাধারণভাবে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছুঁলে তাপ প্রবাহের সতর্কতা জারি করে আবহাওয়া দপ্তর৷ কিন্তু ওই ভগ্নাংশের ঘাটতি পূরণের জন্য আর অপেক্ষা না করে, নিয়মের বই উল্টে রেখে সেদিনই তাপপ্রবাহ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল৷ এবং সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আবহাওয়াবিদরা বলতেই পারছিলেন না, কবে এই অস্বাভাবিক উত্তপ্ত পরিস্থিতি থেকে রাজ্যের রেহাই মিলবে৷ এক সপ্তাহের মাথায় যদিও আবার দু-এক পশলা বৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, কিন্তু গরম যে আবার মহাসমারোহে ফিরে আসবে এবং জাঁকিয়ে বসবে, সেই আশঙ্কায় ত্রস্ত সবাই৷
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, কলকাতায় হামলা করা এই তাপপ্রবাহ কিন্তু গাঙ্গেয় সমতলভূমিকে যখন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে, ভারতের মরু অঞ্চলের শহরগুলোতে তখন কিন্তু তাপমাত্রা যথেষ্ট স্বাভাবিক! কলকাতায় যেদিন ৩৯,৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল, রাজস্থানের জয়পুরে সেদিন তাপমাত্রা ছিল রীতিমত স্বস্তিদায়ক ৩১ ডিগ্রি৷ দেশের বাইরে দুবাইতে তাপমাত্রা ছিল আরও কম, ২৮ ডিগ্রি৷ আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মরু অঞ্চলেও তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালের শুরুতে ক্রমশ উপরে উঠতে থাকে, আচমকা পাঁচ-ছয় ডিগ্রি বেড়েও যায় এক দিনে, কিন্তু সেটা ঘটে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে৷ পশ্চিমবঙ্গের মত অঞ্চলে একই ঘটনা ঘটে আরও দেরিতে৷ সেখানে মার্চ মাসের শেষেই এভাবে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠাটা শুধু অস্বাভাবিকই নয়, উদ্বেগজনকও বটে৷
এই উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্ব আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নিয়ে জাতিসংঘের সদ্য প্রকাশ করা একটি রিপোর্ট, যেখানে ভারত-সহ গোটা এশিয়ারই ক্রমশ অস্বাভাবিক হারে উত্তপ্ত হয়ে ওঠার পূর্বাভাস করেছেন আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা৷ ওঁরা বলেছেন, ভারত বা চীনের মতো দেশে এই উত্তপ্ত আবহাওয়ার খারাপ প্রভাব পড়বে কৃষির উপর এবং ক্রমশ এক ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দেবে৷ খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে সব কিছুর ফলন কমবে এবং পানীয় জলেরও গভীর সংকট হবে৷ পরিস্থিতি সেই মারাত্মক পর্যায়ে না গেলেও এই মরসুমেই প্রচণ্ড গরমের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে কৃষিজ উৎপাদন৷
কিন্তু কেন এরকম হচ্ছে! আবহাওয়াবিদ এবং পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সমস্বরে বলছেন, নির্বিচারে গাছপালা কেটে ফেলা এবং জলাজমি বুজিয়ে ফেলাই এর প্রধানতম কারণ৷ যদিও আইন সংশোধন করে জলাজমি বোজানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অনেক এলাকাতেই মানুষ সচেতন হয়েছেন বলে প্রাকৃতিক জলাজমি এখন সংরক্ষিত হচ্ছে৷ কিন্তু গাছ কাটা ঠেকানো যায়নি৷ অরণ্য অঞ্চলে গরিব মানুষ জ্বালানির প্রয়োজনে গাছ কাটছেন, শহরে উন্নয়নের প্রয়োজনে, কখনও রাস্তা চওড়া করতে, কখনও ফ্লাইওভার বানাতে গাছ কেটে ফেলতে হচ্ছে৷ এছাড়া অসাধু কাঠ ব্যবসায়ীরা বেআইনিভাবে কত গাছ কেটে ফেলছে, তার তো কোনও হিসেবই নেই৷
ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা বাড়ছে৷ এবারেই যেমন গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে এই প্রবল অস্বাভাবিক তাপ প্রবাহের একমাত্র কারণ, বিহার ঝাড়খণ্ডের দিক থেকে ধেয়ে আসা গরম হাওয়া, যা অবাধে ঢুকে পড়তে পেরেছে, নিমেষে শুষে নিয়েছে বাতাসের সমস্ত জলীয় বাষ্প এবং আর্দ্রতা এবং অসহনীয় করে তুলেছে উত্তাপ৷ গ্রীষ্মের একেবারে তুঙ্গমুহূর্তে যে ধরনের তাপমাত্রা থাকে, তার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে চৈত্রের শেষেই৷
শারীরিক অস্বস্তির পাশাপাশি নানা ধরনের অসুস্থতাও বাড়ছে এই উত্তপ্ত আবহাওয়ায়৷ হিট স্ট্রোকে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে৷ এছাড়া অসুস্থতা ছড়াচ্ছে পরোক্ষ উপায়ে৷ এই ধরনের গরম হঠাৎ পড়লে, যাঁদের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয়, তাঁরা শরীর ঠান্ডা করতে নানা ধরনের পানীয় কিনে খান৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাস্তার ধারের পানীয় বিক্রেতা যারা, তারা স্বাস্থ্যবিধি খুব একটা মেনে চলেন না৷ ফলে জন্ডিস-টাইফয়েডের মতো নানা ধরনের জলবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত৷ এছাড়া চেনা-অচেনা ভাইরাসের সংক্রমণ তো আছেই৷ মার্চ শেষের অস্বাভাবিক গরম সেইসব আশঙ্কাকেই আরও একটু জোরদার করেছে৷