বন্যায় গরু আর ধান নিয়ে বিপাকে হাওরবাসীরা
২০ জুন ২০২২নেত্রকোণার হাওর সংলগ্ন সবচেয়ে বেশি প্লাবিত খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের পাশেই উত্তর আঁটিপাড়ার বাসিন্দা ফালাক মিয়া মাসখানেক আগেই গোলায় ধান তুলেছিলেন৷ ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে রোববার বিকালে বলেন, ‘‘ আমার প্রায় ৮০০ মণ ধানের গোলায় এখন তিন থেকে চার ফুট পানি৷ বাজারের ভাড়া গুদামে রাখছিলাম৷ পানির নিচে যে ধান তলিয়েছে সেই ধান যে কী হয়, জানি না৷ বাড়িতে গরু-বাছুর-ছাগল আছে, হাঁস-মুরগি আছে৷ এসব নিয়ে কই যামু?’’
পঞ্চাশোর্ধ্ব এই কৃষক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘‘ যাওয়ার মতো অবস্থা নাই৷ এইবার এক্কেরে সর্বনাশের মইধ্যে পড়ছি৷’’
একই গ্রামের ৪০ বছর বয়সি মনির হোসেন বলেন, ‘‘ আমার গোলায় প্রায় দুই হাজার মণ ধান৷ ঘরের মধ্যে তিন থেকে চার ফুট বানের পানি৷ ধান পানিতে ভেইজ্যা আছে৷ কী করতাম, কিবায় বাঁচাম৷ ’’
একই উপজেলার কাদিরপুর গ্রামের রিপন সরকারের গোলায় থাকা প্রায় ৫০০ মণ ধান এখন পানির নিচে৷ সেই সঙ্গে গবাদি পশু রাখা নিয়েও পড়েছেন সংকটে৷ ‘‘ আমার আটটা গরু৷ তারারে সরানির জায়গা নাই৷ পানির মধ্যেই একটু উঁচু জায়গা দেইখ্যা রাখছি৷ চোরের ভয়ে নিজেও হেইখানে থাকি৷’’
গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়ার কথা জানালেন খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের পাশের উত্তর আঁটিপাড়ার মিন্টু মিয়া, রূপনগর গ্রামের একদিল মিয়া৷
মিন্টুর গরু-বাছুর মিলিয়ে ছয়টি আর একদিল মিয়ার চারটি৷ এর মধ্যে কোরবানির জন্য তৈরি করা পশুও আছে৷ গবাদিপশু রাখার পাশাপাশি গো-খাদ্যের সংকটের কথা বললেন তারা৷
একদিল মিয়ার চারটি গরুর মধ্যে একটি শংকর জাতের বড় ষাঁড়৷ এটা বিক্রি করেই তার সারা বছরের পরিবারের খোরাকি, মহাজনের ঋণ শোধ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালানোর কথা৷ এগুলো নিয়ে দুই দিন ধরে উপজেলার ডাকবাংলোর সামনে পড়ে আছেন তিনি৷ পরিবার উঠেছে খালিয়াজুরী কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে৷পানি নামলে পরে বাড়ি ফিরবেন৷
একদিল বলেন, ‘‘ খড়ের লাচিও ডুবে গেছে৷ সব আশা শেষ৷ গরুরে খাওয়াব কী? এখন ভরসা কিনে খাবার খাওয়ানো৷ আমার সেই সামর্থ্য নেই৷ গরুগুলো না খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে৷ সামনে কী করব বুঝতে পারছি না৷’’
মিন্টু মিয়ারও একটি বড় ষাঁড় এবারের কোরবানি ঈদে বিক্রি করার কথা৷ এখন সেই ষাঁড় তার জন্য গলার ফাঁস হয়ে গেছে৷ তিনি উঠেছেন খালিয়াজুরী মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে৷
তিনি বলেন, ‘‘ নিজেদের ঘরই ডুবে গেছে, গরু রাখব কোথায়? নিজেদেরই খাবার নেই গরুকে কী খাওয়াব?’’
একদিল মিয়া, মিন্টু মিয়ার মতো হাওরে অনেক কৃষক কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশু লালন-পালন করেছেন৷ প্রতিবছরই তারা এটা করেন৷ কৃষির পাশাপাশি এটা তাদের উপার্জনের একটি বড় মাধ্যম৷ এখন না পারছেন গরু বিক্রি করতে, না পারছেন রাখতে৷ খোলা আকাশের নিচে এখন গবাদি পশুর সঙ্গে মিলেমিশে দিন কাটাচ্ছেন হাওরবাসী৷ এই উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ৭০টি গ্রামের চিত্র প্রায় একই৷
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘সবচেয়ে সব সমস্যা হচ্ছে, মানুষের গবাদিপশু ও সারা বছরের জমা ধান রয়েছে বাড়িতে৷ এ নিয়ে মানুষ খুব বিপদে আছেন৷ এগুলো রেখে তারা আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চাচ্ছেন না৷ এখন বড় নৌকাও পাওয়া যাচ্ছে না৷ উপজেলা প্রশাসন একটা বড় নৌকা সংগ্রহ করেছে৷ এটা দিয়ে অভিযান শুরু হয়েছে৷ ’’
মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে জানান খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম৷
এনএস/কেএম (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)