ফ্যাক্ট চেক: গরিব দেশগুলি করোনা টিকা পাবে না
১১ ডিসেম্বর ২০২০দশটির মধ্যে নয়টি গরিব দেশের আগামী বছর করোনার ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা কম৷ কারণ, বিশ্বের ধনী দেশগুলি অধিকাংশ ভ্যাকসিনই নিজেদের দেশে ব্যবহারের জন্য কিনে নিচ্ছে৷ এই আশঙ্কা পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের৷ এই অ্যালায়েন্সে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, গ্লোবাল জাস্টিস নাউ, অক্সফার্ম সহ একাধিক সংগঠন আছে৷ এই ধরনের ঘোষণা খুব সহজেই সংবাদমাধ্যমে হেডলাইন হয়৷ তাই এর ফ্যাক্ট চেক জরুরি৷
এখন যাঁরা ভ্যাকসিন তৈরি করছে, সেই অ্যাস্ট্রাজেনেকা, বায়োটেক/ফাইজার, মডার্নার মতো কোম্পানির হিসাব হলো, তারা ২০২১-এ ভ্যাকসিনের ৫৩০ কোটি ডোজ তৈরি করতে পারবে৷ করোনা রুখতে গেলে একজনকে দুইটি ডোজ নিতে হবে৷ সেই হিসাবে বিশ্বের ৭৬০ কোটি মানুষের মধ্যে এক তৃতীয়াংশের কাছেই ভ্যাকসিন পৌঁছবে৷
এরপরই প্রশ্ন আসে, ভ্যাকসিন কীভাবে বিভিন্ন দেশে পৌঁছবে? প্রচুর ধনী দেশ ভ্যাকসিন কেনার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করেছে৷ ফলে গরিব দেশ, যাঁরা এই ভ্যাকসিন কেনার লড়াইয়ে থাকতে পারবে না, তাঁদের কী হবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে৷
ইন্টাব়্যাক্টিভ মানচিত্রটি দেখা না গেলে এই লিংকে ক্লিক করুন৷
সমালোচকরা বলছেন, বিশ্বের সব মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া সম্ভব৷ কিন্তু ধনী দেশগুলি এ ক্ষেত্রে গরিব দেশের ভ্যাকসিন পাওয়ার রাস্তা বন্ধ করছে৷ আর ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকরা মানুষের স্বাস্থ্যের তুলনায় তাদের লাভকে বড় করে দেখছে৷ ডিডাব্লিউর ফ্যাক্ট চেক টিম বৃহত্তর ছবিটা বিশ্লেষণ করে দেখাতে চেয়েছে৷
পশ্চিমা দেশগুলির কাছে কি ভ্যাকসিনের যথেষ্ট ডোজ থাকবে, যা দিয়ে সব মানুষকে একাধিকবার টিকা দেয়া যাবে?
ডিডাব্লিউ ফ্যাক্ট চেকঃ বিভ্রান্তিকর
ধনী দেশগুলিতে বিশ্বের ১৪ শতাংশ মানুষ থাকেন৷ এখনো পর্যন্ত ওই দেশগুলি ৫৩ শতাংশ ভ্যাকসিন কিনে নিয়েছে বলে রিপোর্ট জানাচ্ছে৷ এর ফলে ধনী দেশগুলি তাদের দেশের মানুষকে তিন বার ভ্যাকসিন দিতে পারবে৷
কিন্তু এই দাবি বিভ্রান্তিকর৷ এই দাবির পিছনে একটা ধারণা আছে, সব ভ্যাকসিন ক্লিনিকাল পরীক্ষায় পাস করে যাবে এবং অনুমোদন পাবে৷ ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানির সঙ্গে ধনী দেশগুলি যে ইতিমধ্যে চুক্তি করেছে এটা ঠিক৷ কিন্তু এই ভ্যাকসিন নিরাপদ কি না, তা সফল কি না, তা জানার আগেই ধনী দেশগুলি ভ্যাকসিন কেনার জন্য দৌড়চ্ছে৷ তাদের জন্য কোম্পানিগুলি ভ্যাকসিন রিজার্ভ করে রেখেছে মানে এই নয় যে, সব কোম্পানি অনুমোদন পাওয়ার পর সফলভাবে ওই ভ্যাকসিনের প্রচুর উৎপাদন করতে পারবে৷ সংক্ষেপে সেই সব ভ্যাকসিনকে সংরক্ষিত করে রাখা হচ্ছে, যার পরীক্ষা এখনো চলছে৷
যেমন, ক্যানাডা৷ পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স জানাচ্ছে, দেশের জনসংখ্যার তুলনায় বহুগুণ বেশি ভ্যাকসিনের অর্ডার দিয়েছে তারা৷ সাতটি কোম্পানির কাছ থেকে ৪১ কোটি ৪০ লাখ ডোজ কেনার জন্য ক্যানাডা চুক্তি করেছে৷ কিন্তু ক্যানাডার সরকার জানিয়েছে, সব ভ্যাকসিনকে প্রি-ক্লিনিকাল ও ক্লিনিকাল পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে৷ তারপর হেল্থ ক্যানাডা দেখবে ওই ভ্যাকসিন নিরাপদ, কার্যকর কি না৷ উৎপাদনের মান কী৷ এরপরে তা মানুষকে দেয়া হবে৷
এই মানসিকতা নিয়ে তিনটি বড় কোম্পানির সঙ্গে ক্যানাডার সাত কোটি ৬০ লাখ করে ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য চুক্তি হয়েছে৷ যদি একটি কোম্পানির ভ্যাকসিন সফল হয় এবং তারা ক্যানাডাকে ৭ কোটি ৬০ লাখ ডোজ দেয়, তা হলে তা দিয়ে ক্যানাডার সব মানুষকে দুই বার ভ্যাকসিন দেয়া সম্ভব হবে৷
গরিব দেশগুলির ভ্যাকসিন পেতে কি দেরি হবে?
ডিডাব্লিউ ফ্যাক্ট চেকঃ সত্যি
ডিউক গ্লোবাল হেলথ ইনোভেশনের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০২৩ বা ২৪-এর আগে বিশ্বের সকলকে ভ্যাকসিন দেয়া সম্ভব হবে না৷ অক্সফার্মের হেলথ পলিসি ম্যানেজার অ্যানা ম্যারিয়টও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে বলেছেন, যদি নাটকীয় কোনো পরিবর্তন না হয়, বিশ্বজুড়ে কয়েকশ মানুষ আগামী বছরগুলিতেও ভ্যাকসিন পাবেন না৷
এটা মাথায় রেখেই দেশগুলি কৌশল নিয়েছে যে, যাঁদের আগে প্রয়োজন, তাঁদের প্রথমে ভ্যাকসিন দেয়া হবে৷ কিন্তু যে সব গরিব দেশের ভ্যাকসিন কেনার ক্ষমতা নেই, তাদের কী হবে?
এটা ঠিক, গরিব দেশগুলির কাছে সহজে ভ্যাকসিন পৌঁছবে না৷ কিন্তু তাই বলে এটা মনে করার কারণ নেই, শুধু ধনী দেশগুলি ভ্যাকসিন পাবে, অন্যরা নয়৷ সকলেই যাতে ভ্যাকসিন পায়, তার চেষ্টা করা হচ্ছে৷
এখানেই কোভ্যাক্স পুলের গুরুত্ব৷ এটা গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস, কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপায়ার্ডনেস ইনোভেশনস এবং ডাব্লিউএইচও-র নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে৷ তাদের লক্ষ্য, ভ্যাকসিন তৈরির গতি বাড়ানো এবং বিশ্বের সব দেশ যাতে এই ভ্যাকসিন পায় তা নিশ্চিত করা৷
কোভ্যাক্সের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে ভ্যাকসিনের দুইশ কোটি ডোজ সরবরাহ করা৷ আর গরিব দেশগুলিকে নিজেদের অর্থে ভ্যাকসিন দেয়া, যাতে সেই সব দেশের ২০ শতাংশ মানুষ যাতে ভ্যাকসিন পান সেটা নিশ্চিত করা৷
বিশ্বের ৮০টি ধনী বা প্রায় ধনী দেশ ৯২টি গরিব ও মাঝারি আয়ের দেশকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে বলে ঠিক হয়েছে৷ এই ১৭২টি দেশে বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ থাকেন৷
এই পরিকল্পনার লক্ষ্য, বিশ্বের বিভিন্ন ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক যে ভ্যাকসিন তৈরি করবে, তাদের থেকে নিয়ে সরকারের কাছে তা পৌঁছে দেয়া৷ অধিকাংশ ধনী দেশ কোভ্যাক্সকে সাহায্য করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যাতে গরিব দেশগুলিও ভ্যাকসিন পায়৷
ফাইজার ও বায়ো টেকও করোনার প্রতিষেধক গরিব দেশে দিতে উৎসাহী৷ অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানিয়েছে, তাদের ৬৪ শতাংশ ডোজ উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জন্য থাকবে৷ ইইউ ইতিমধ্যেই কোভ্যাক্সকে ৫০ কোটি ইউরো দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে৷
এই অবস্থায় মনে হচ্ছে, গরিব দেশগুলি ভ্যাকসিন পাবে, কিন্তু তা তাদের হাতে পৌঁছতে কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে৷
ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকরা কি জনস্বাস্থ্যের থেকে লাভকে গুরুত্ব দিচ্ছে?
ডিডাব্লিউ ফ্যাক্ট চেকঃ অপ্রমাণিত
অনলাইনে নানা ধরনের পরষ্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া যাচ্ছে এই বিষয়ে৷ এর জবাব নির্ভর করছে, কাকে এই প্রশ্ন করা হচ্ছে, তার উপর৷ পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের কাছে দাবি করেছে, সব ভ্যাকসিন, চিকিৎসা, পরীক্ষা যেন মনোপলি-ফ্রি হয়, সেগুলি যেন বিপুল সংখ্যায় উৎপাদন করা হয় এবং ন্যায্যভাবে বিতরণ করা হয়, সব দেশের সব মানুষ যাতে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন পান, তা দেখা হয়৷
তাদের ধারণা হলো, ওষুধ প্রস্তুতকারক ও গবেষক সংস্থা ভ্যাকসিনের বৈজ্ঞানিক ও ইন্টেলেকচুয়াল তথ্য প্রকাশ করবে, যাতে সব জায়গায় ভ্যাকসিন নিরাপদ ও কার্যকর হয়৷ আর সহজেই যাতে এই ভ্যাকসিন পাওয়া যায়৷
ডক্টরস উইথআউট ব্রোকার্স বলেছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানিয়েছে, করোনাকালে তারা এই ভ্যাকসিন থেকে কোনো লাভ করবে না৷ আগামী বছর জুলাইয়ে তারা ভ্যাকসিনের দাম বাড়াতে পারে৷ জনসন অ্যান্ড জনসনও জানিয়েছে, তারা কোনো লাভ ছাড়াই ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে৷
ফাইজারের ক্ষেত্রে বিষয়টি এরকম নয়৷ তারা অ্যামেরিকার সরকারের কাছ থেকে কোনো অর্থসাহায্য নেয়নি৷ তারা নিজেরা ২০০ কোটি ডলার খরচ করে এই ভ্যাকসিন তৈরি করেছে৷ গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, তারা লাভের মাত্রা কম রাখবে৷ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড্যামিয়েন কনোভার মার্কেটপ্লেসকে বলেছেন, ''বিভিন্ন ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক আলাদা নীতি নেবে৷ যতদিন পর্যন্ত ভ্যাকসিন চূড়ান্তভাবে তৈরি হচ্ছে এবং বাজারে আসছে, ততদিন আর্থিক দিকটা অস্পষ্ট থাকবে৷’’
জর্ডন উইলডন/জিএইচ