‘মোমবাতি মিছিল করলে সমাধান হবে না'
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ভারতের রাজধানীতে গত কয়েকদিনের সহিংসতায় এখনো পর্যন্ত ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ আহতের সংখ্যা দু'শ'র বেশি৷ ১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে ১৯৮৪-র শিখ নিধন, ১৯৯২-র বাবরি মসজিদ ভাঙা থেকে ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যা, এমন অনেক ইতিহাস লেখা হয়েছে কালো অক্ষরে৷ সেই তালিকায় জুড়ে গেল ২০২০-র ফেব্রুয়ারির দিল্লি৷ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে ঘিরে অনেকদিন ধরেই এর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল৷ শাহিনবাগের প্রতিবাদ এবং দিল্লির বিধানসভা ভোটে বিজেপির বিপুল পরাজয়ের পর মনে করা হয়েছিল, এবার নতুন আইন নিয়ে পিছু হটবে কেন্দ্রীয় সরকার৷ কিন্তু তার পরিবর্তে যে ঘটনাক্রম দেখা গেল, তা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক৷
দিল্লির উত্তর-পূর্বাংশে একের পর এক এলাকায় আগুন জ্বলল নয়া আইনের সমর্থন ও বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে৷ রাস্তায় নেমে এলো দুই সম্প্রদায়ের মানুষ৷ তারপর রক্তপাত, ধর্মস্থানে হামলা, বাড়িঘর লুটপাট৷ আরো একবার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে যে ক্ষত তৈরি হলো, তা কি সহজে দূর হবে? সকলেই আশাবাদী, ভালোবাসা দিয়ে ক্ষতে প্রলেপ দেওয়া সম্ভব৷ লেখক-সাংবাদিক চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘মানুষ অনেক অপ্রিয় জিনিস, এমনকি প্রিয়জন বিয়োগের যন্ত্রণাও বিস্মৃত হয়৷ এক্ষেত্রেও সেটা হতে পারে৷ তবে সেজন্য রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে, একই সঙ্গে আক্রান্ত মানুষের আশপাশে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদেরও যত্ন নিতে হবে৷''
মানবাধিকারকর্মী সুজাত ভদ্র-ও তাই মনে করেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশভাগের ইতিহাস বীভৎস৷ তা থেকে আমরা বেরিয়ে এসে একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তৈরি করেছি৷ আমরা পাকিস্তান বা বাংলাদেশ হয়ে যাইনি৷ এই ধরনের ঘটনা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে৷ সবচেয়ে বড় সম্বল হতে পারে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা৷''
ভারতের রাজনীতি বেশ কিছুদিন ধরে উত্তপ্ত৷ নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিকপঞ্জি নিয়ে সুস্থ বিতর্ক হতেই পারে৷ কিন্তু তার পরিণতিতে এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষের রক্ত ঝরল কেন? সুজাত ভদ্রর মতে, ‘‘দিল্লিতে গুজরাট মডেল বাস্তবায়িত হয়েছে৷ রাষ্ট্র অনুমোদিত হিংসা চালানো হয়েছে একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে৷ পুলিশ-প্রশাসন সম্পূর্ণ হাত গুটিয়ে নিয়েছিল৷ তাই গণহত্যা হয়েছে৷'' চন্দ্রিলের মতে, ‘‘রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে সাধারণ মানুষের মধ্যে সুপ্ত হিংসাকে জাগিয়ে তোলেন, তাদের লড়িয়ে দেন৷ এর সমাধান কী আমি জানি না৷ ফেসবুকে লিখে বা মোমবাতি মিছিল করে এর সমাধান হবে না৷ প্রশাসনকে অত্যন্ত দৃঢ় হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে৷ গোটা পৃথিবীতেই একই ধরনের রাজনীতি হচ্ছে৷ একটা সম্প্রদায়কে দেগে দিয়ে বলা হচ্ছে, এরা চলে গেলে স্বর্গরাজ্য নেমে আসবে, এটা দুঃখের বিষয়৷''
প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় উদ্বেগের সঙ্গে বলেন, ‘‘একটা আইনকে কেন্দ্র করে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে চলে যাচ্ছে৷ দুই পক্ষকে সংযত হতে হবে, কঠোর হাতে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে প্রশাসনকে৷ নইলে দিল্লির পুনরাবৃত্তি রোখা যাবে না৷''
ভারত কি ধাপে ধাপে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে? চন্দ্রিল মনে করেন, ‘‘রাজনৈতিক দলের পরিকল্পনা যা-ই থাক, মানুষ যদি এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করে, তাহলে সেটা সহজ হবে না৷ নির্দিষ্ট একটি ধর্মের নামে রাষ্ট্র ঘোষণা করাটা যে কঠিন, তা সাম্প্রতিক অতীতে দেশজোড়া প্রতিবাদ থেকেই বোঝা যাচ্ছে৷'' একই মত সুজাত ভদ্রের৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে হত্যা করে হিন্দুরাষ্ট্র তৈরির চেষ্টা চলছে. কিন্তু সেটা অত সহজ হবে না৷ সব সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতিবাদ করছে৷ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষের সমর্থন না থাকলে এটা হতো না৷''