প্রচণ্ড ঠান্ডায় শীতবস্ত্র ও খাদ্যের অভাবে অসহায় যারা
১২ জানুয়ারি ২০২৪এ পর্যন্ত শীত উপদ্রুত প্রতি জেলায় গড়ে ৩০ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম৷ তাছাড়া, যে কোনো কাজে ঘরের বাইরে যেতে যে ধরনের শীতবস্ত্রের প্রয়োজন সেগুলো যথেষ্ট দেয়া হচ্ছে না।
জেলা প্রশাসন নিজেদের উদ্যোগে কম্বল বিতরণ করছে। নির্বাচনের কারণে জেলাগুলোতে এখনো সরকারি ত্রাণ সহায়তা যায়নি।
শীতে নিম্নবিত্ত মানুষ কী পরিমাণ কষ্টে আছে তা পঞ্চগড়ের সালেহা বেগমের (৫০) কথায়ই বোঝা যায়। তিনি থাকেন পঞ্চগড় সদরের স্লুইস গেট এলাকায় নদীর পাড়ের ঝুপড়ি ঘরে। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা কম্বল, কাঁথা কিছুই এখন পর্যন্ত পাই নাই। কাজ কর্ম নাই। খাবারের অভাব। পুরোনো ঘর। বাইরে থেকে বাতাস ঢোকে। রাতে অনেক কষ্ট হয়।” তিনি আরো বলেন, "কেউ কম্বলই দেয়নি। সোয়েটার, চাদর কে দেবে! অনেক কষ্টে আছি। কেউ খোঁজ নেয় না।”
পঞ্চগড় জেলায় মোট জনসংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। পাঁচটি উপজেলা। সেখানে কমপক্ষে চার থেকে সাড়ে চার লাখ নিম্নবিত্তের এই শীতে গরম কাপড়, খাদ্য ও অর্থ সাহায়তা দরকার। জেলা প্রশাসক জহিরুল ইসলাম জানান, তারা এ পর্যন্ত ৩০ হাজারের মতো কম্বল বিতরণ করেছেন। তিনি বলেন, "আমরা কম্বল বা অন্যান্য গরম কাপড় যখন যেটা পাই বিতরণ করি। নির্বাচনের কারণে যাতে আচরণবিধি লঙ্ঘন না হয় এজন্য আমরা আমাদের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিতরণ করেছি। আর কিছু এনজিও আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করে গরম কাপড় বিতরণ করছে। স্থানীয় বিত্তশালীরাও সহায়তা করছে।”
কুড়িগ্রাম সদরের দাড় মোল্লাপাড়ায় বসবাস করেন ক্ষুত্র ব্যবসায়ী মো. কামাল হোসেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমাদের এখানকার অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা এখন পর্যন্ত কোনো গরম কাপড় বা অন্য কোনো ধরনের সহায়তা পাইনি। আমি নিজে গরিব মানুষ. তারপরও কিছু গরম কাপড় সংগ্রহ করে গরিবদের দিচ্ছি। কিন্তু কতজনকে দেবো? কোনো সরকারি সহায়তা নাই। এমপি সাহেবের দেখা পাই না।”
তার কথা, "এই এলাকায় অনেক গরিব মানুষ। চরাঞ্চলের অবস্থা আরো খারাপ। আপনারা আমাদের সহায়তার জন্য কিছু লেখেন, ভাই।”
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরিফ জানান, তারা ৫২ হাজার কম্বল বরাদ্দ দিয়েছেন। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪৩ হাজার বিতরণ করেছেন। এর বাইরে বেসরকারি উদ্যোগে শিশু ও কর্মজীবী মানুষের জন্য কিছু জ্যাকেট ও সোয়েটারের ব্যস্থা করা হয়েছে। কিছু শুকনো খাবারও বিতরণ করা হয়েছে। কিছু পরিবারকে ঘরের টিন দেয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, "আসলে ঠিক কত লোকের সহায়তা দরকার সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই। ফলে আমরা আমাদের মতো সহায়তা করছি। আমাদের ভালো ডাটাবেজ না থাকায় এমনও হয় একজন একাধিকবার পান, আরেকজন পান না।”
কুড়িগ্রাম জেলায় জনসংখ্যা ১৮ লাখেরও বেশি। উপজেলা ৯টি। জেলার এনজিও কর্মী রুকনুজ্জামান রুকু বলেন," আমাদের হিসেবে জেলার কমপক্ষে চার লাখ লোকের এখন কাজ নাই। তারা বছরের অন্য সময়ে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে কাজ করেন। তারা এখন খুব কষ্টে আছেন। তাদের হাতে কাজ নেই। যাদের হাতে কাজ আছে তারাও শীতের কারণে করতে পারছেন না। তাই এখন তাদের গরম কাপড় ছাড়াও খাদ্য ও অর্থ সহায়তা দরকার।”
উত্তরাঞ্চলের এনজিও ‘জীবিকার' পরিচালক মানিক চৌধুরী জানান, "এবার সরকারি সহায়তা কম। এনজিওগুলোও খুব বেশি সহায়তা করছে না। ডিসেম্বরে শীত তেমন ছিল না। তবে গত এক সপ্তাহ ধরে তীব্র শীতে মানুষ কষ্টে আছে। সারা দিনে সূর্যের দেখা মেলে না। এমনিতেই এই অঞ্চলের মানুষ অবহেলিত। এখন কাজও কম। শীতে বাইরে যেতে পারছে না।”
তিনি বলেন, "সরকাারি যে সহয়তা দেয়া হচ্ছে তা কম্বল। কিন্তু মানুষের বাইরে যেতে গরম কাপড় দরকার। তা পাওয়া যাচ্ছে না। দরকার খাদ্য। প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে চার লাখ মানুষের সহায়তা দরকার এই শীতে। কিন্তু পাচ্ছে অনেক কম মানুষ।”
লালমনিরহাট ও রংপুরে জেলা প্রশাসন জেলা সদর ও উপজেলা সদরে কিছু কম্বল বিতরণ করেছে। কিন্তু প্রত্যন্ত চরের মানুষ, ভাসমান ও ছিন্নমূল মানুষ কম্বল বা গরম কাপড় পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি একাধিকবার পাচ্ছে। তালিকা ঠিকমতো হচ্ছে না।
লালমনির হাট জেলা প্রশাসনের সহকারি কমিশনার (ত্রাণ ও পুনর্বাসন) মাহবুবুর রহমান বলেন, "আমাদের এখানে পাঁচটি উপজেলায় মোট ২৪ হাজার কম্বল পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আর জেলা প্রশাসকের অফিস খেকেও আলাদাভাবে চার-পাঁচ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। তবে গরম কাপড় (জ্যাকেট, সোয়েটার) এগুলো আমাদের এখানে নেই। আমরা চাহিদা পাঠিয়েছি।” এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "শীতে যাদের কাজ নেই বা কাজে যেতে পারেন না, তাদের জন্য অর্থ বা খাদ্য সহায়তার কোনো প্রকল্প আমাদের নেই।”
রাজধানী ঢাকায়ও এই শীতে গরিব ও শ্রমজীবী মানুষ কষ্টে আছে। কলাবাগানের রিকশা চালক শাহীন মিয়া ও ফরিদ আলম জানান, এই শীতে তারা ঠিকমতো রিকশা চালাতে পারছেন না। যাত্রীও কম। তাই তাদের আয় কমে গেছে। শাহীন মিয়া বলেন, " নিজের ও পরিবারের জন্য কম্বল বা গরম কাপড় কিনতে পারছি না। শীতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কোনো সহায়তা পাচ্ছি না।” গৃহকর্মী রমিজা বেগম বলেন, "এই শীতে আমাদের দেখার কেউ নেই। এত বড় নির্বাচন গেল, তখনো কেউ কিছু দেয় নাই। নির্বাচনের পরেও কেউ কিছু দিচ্ছে না। শীতে ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে আছি।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে নির্বাচনের কারণে জেলা প্রশাসন সারা দেশে তাদের কাছে যে ত্রাণসামগ্রী আছে তা-ই বিতরণ করছেন। অনেক জেলা থেকে চাহিদা জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছে। এখন হয়তো আরো গরম কাপড় পাঠানো হবে। কিন্তু ভালো ডাটাবেজ না থাকায় বিতরণ ঠিকভাবে হবে কিনা সে বিষয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর শুক্রবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে চুয়াডাঙ্গা ও কিশোরগঞ্জের নিকলিতে৷ সেখানে তাপমাত্রা ছিল ৯.৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।