পোশাক শ্রমিকদের মজুরি : ছয় মাস নিয়ে আর কত নয়ছয়?
১১ অক্টোবর ২০২৩তবে মালিক পক্ষ ও বোর্ডের সদস্যরা বলছেন, পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি নির্ধারণে এক মাসের বেশি সময় লাগবে না। জানুয়ারি থেকে নতুন মজুরি কার্যকর হতে পারে। কিন্তু শ্রমিক সংঠনগুলো ২৩ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করলেও সেটা সম্ভব হবেনা বলে জানান তারা। তারা বলছেন, শিল্পের সক্ষমতা বিবেচনা করে মজুরি বাড়ানো হবে।
২০১৮ সালে সর্বশেষ পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়। তখন তারা ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা দাবি করলেও মজুরি নির্ধারণ করা হয় আট হাজার টাকা। ১১টি শ্রমিক সংগঠন এখন ন্যূনতম মজুরি দাবি করছে ২৫ হাজার টাকা। তবে শ্রমিকদের আরেকটি জোট মনে করে, ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত ২৩ হাজার টাকা। অন্যদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক গবেষণায় বলছে, সার্বিক বিবেচনায় শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা।
মজুরি কত হওয়া উচিত তা নিয়ে নানা ধরনের মত থাকলেও মূল্যস্ফীতির এই সময়ে যে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি দ্রুত বাড়ানো উচিত তা নিয়ে কারো দ্বিমত নেই।
গত ৯ অক্টোবর মজুরি বোর্ডের ছয় মাসের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু এই ছয় মাসের মধ্যে ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব না দিয়ে সময় বাড়ানো হয়েছে।
ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, "আমরা ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা চেয়েছি। বেসিক শতকরা ৬৫ ভাগ , ১০ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট। আর পঞ্চম গ্রেড চেয়েছি।”
তার কথা, "আমরা যখন এই মজুরি প্রস্তাব করি তারপর নিত্যপণ্যের দাম আরো বেড়েছে। চারজনের একটি পরিবার কোনোভাবেই ২৫ হাজার টাকার কমে চলতে পারে না। ডলারের দাম বেড়ে গেছে। তাতে মালিকপক্ষ লাভবান হয়েছে। তারা ডলারে পোশাকের দাম পাচ্ছে। ফলে টাকায় সেটা বেশি। কিন্তু শ্রমিকরা আগের মজুরিই পাচ্ছেন।”
শ্রমিকরা ১১ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত সভা-সমাবেশসহ প্রচার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। জলি তালুকদার বলেন, " মজুরি বোর্ড আরো সময় বাড়িয়ে নিয়ে শ্রম আইনের লঙ্ঘন করেছে। শ্রমিকদের মধ্যে এখন যে ক্ষোভ তা যেকোনো সময় আউটবার্স্ট করতে পারে।”
গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিটি কাউন্সিলের সভাপতি মো. তৌহিদুর রহমান বলেন, " এখন শ্রমিকদের যে মজুরি দেয়া হয় তা দিয়ে ১০-১২ দিনের বেশি তারা পরিবার নিয়ে চলতে পারেন না। দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যাদের সঞ্চয় ছিল তা তারা ভেঙে খেয়ে ফেলেছেন, কোনো সঞ্চয় নেই। অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ঋণের কিস্তি শোধ করতে গিয়ে তারা আরো বিপাকে পড়ছেন। সন্তানের লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছে। সাধারণ স্কুল বাদ দিয়ে মাদ্রাসায় দিয়েছেন সন্তানকে। কারণ, ওখানে লেখাপড়া ফ্রি, ফ্রি খাবার দেয়। চিকিৎসা করাতে পারছেন না। সরকারি হাসপাতালে সকালে গিয়ে তাদের পক্ষে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব নয়।”
তার কথা," এই পরিস্থিতিতে দ্রুত শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো দরকার। আমরা ফুড, নন-ফুড ও হাউজ রেন্ট হিসাব করে চারজনের একটি পরিবারের জন্য একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা দাবি করেছি।”
সিপিডির ন্যূনতম ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা মজুরি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, "তাদের মতো দায়িত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠান এই প্রস্তাব কিভাবে দিলো আমি জানি না। তবে এটা আমাদের শ্রমিকদের বিপক্ষে গেছে।”
"এর মধ্যে আবার মজুরি বোর্ড সময় বাড়িরে নেয়ায় আমরা শ্রমিকরা ধোঁয়াশার মধ্যে পড়ে গেছি। কবে মজুরি বাড়বে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদিও পোশাক শিল্পের মালিকরা বলেছেন দ্রুতই মজুরি বাড়ানো হবে, ”বলেন এই শ্রমিক নেতা।
তবে সিপিডির সিনিয়র গবেষণা সহকারি তামিম আহমেদ বলেন, "আমরা ২২৮ জন শ্রমিক এবং ৭৬টি কারখানায় জরিপ করে ওই মজুরি প্রস্তাব করেছি। পরিবারের আকার ধরেছি ৩.৭ জন। আর এক পরিবারে একাধিক লোক পোশাক কারখানায় কাজ করেন সেটাও বিবেচনায় নিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগ তাদের জন্য একটি ফুড বাস্কেট তৈরি করে দিয়েছে। আমরা সেটার দাম এবং মূল্যস্ফীতি হিসাব করেছি। আর নন ফুড আইটেম তারা যা কেনে তার দাম তারাই বলেছেন। এরপর স্বীকৃত পদ্ধতি প্রয়োগ করে ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করেছি।” তিনি জানান, "বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক কারখানা শ্রমিকরা ২০১৮ সালে ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি ( আট হাজার টাকা) এখনো পান না।”
মজুরি বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে আছেন বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি। তিনি বলেন, "সময় বাড়িয়ে নিলেও আমরা নভেম্বর মাসের মধ্যেই নতুন মজুরি প্রস্তাব করবো। তারপর মালিদের সঙ্গে দরকষাকষি করে চূড়ান্ত হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত লেগে যাবে। জানুয়ারি থেকে নতুন মজুরি কার্যকর হবে বলে আশা করছি।”
তিনি জানান, " আমরা ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার রাখার চেষ্টা করছি। এর নীচে আমরা যাবো না। তারপর মালিকদের সঙ্গে দর কষাকষি করে যা ঠিক হয় সেটাই হবে ন্যূনতম মজুরি। তবে ২০ হাজার টাকার নীচে এখন শ্রমিকদের চারজনের একটি পরিবার চালানো অসম্ভব হয়ে গেছে। এখন যা বাজার-মূল্য তাতে খাবার, বাড়ি ভাড়া এসব মিটাতেই ওই টাকা শেষ হয়ে যাবে।”
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, "মজুরি বোর্ড ছয় মাসের পর সময় বাড়িয়ে নিতে পারে। এটা আইনেই বলা আছে। ছয় মাসের পর কাজ শেষ করতে যে সময় লাগে তা বোর্ড নিতে পারে।”
এদিকে বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, "আমরা মূল্যস্ফীতিসহ সব দিক বিবেচনা করে অবশ্যই শ্রমিকদের মজুরি বাড়াবো। আশা করি এই মাসের মধ্যেই আমরা একটি জায়গায় যেতে পারবো, মজুরি ঠিক করতে পারবো। এটা নিয়ে আমরা যারা স্টেক হোল্ডার আছেন, সবার সঙ্গেই কথা বলছি, আলোচনা করছি। মজুরি বোর্ডে আমাদের প্রতিনিধি আছেন। তিনি কথা বলছেন। তবে বিষয়টি হবে উইন উইন সিচুয়েশন। ২৩ থেকে ২৫ হাজার টাকা দাবি করলেই তা দেয়া সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, "শ্রমিকদের নিয়েই আমাদের পোশাক শিল্প। তাদের অবশ্যই আমরা দেখবো। তাদেরও দেখতে হবে আমাদের দিকটা। আমাদের ব্যবসা তো বাড়েনি। ডলার সংকট আছে, রপ্তানি কমছে- সববিছুই বিবেচনায় নিতে হবে। শিল্পের সক্ষমতা দেখতে হবে।”