পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করছে জার্মান স্যাটেলাইট
২৯ জুন ২০১০হলিউডের সফল চলচ্চিত্র ‘অবতার'এর মূল আকর্ষণই ত্রিমাত্রিক জগত৷ একের পর এক টেলিভিশন সেট বাজারে আসছে, যার পর্দায় ‘থ্রি ডি' ছবি দেখা যায়৷ এবার পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করতে শুরু হলো এক মহাকাশ অভিযান৷
‘টু ডি'র দ্বিমাত্রিক চ্যাপ্টা ছবি আর কারো মনে ধরছে না৷ তাই ত্রিমাত্রিক প্রযুক্তিকে ঘিরে চারিদিকে নতুন এক উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ এবার পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক ছবি তুলতে ‘ট্যান্ডেম এক্স' নামের এক স্যাটেলাইট পাঠানো হলো মহাকাশে৷ প্রায় ১৫ কোটি বর্গ কিলোমিটার এলাকার উন্নত ত্রিমাত্রিক ছবি তোলা হবে এই প্রকল্পের আওতায়৷
প্রকল্পের রূপরেখা
‘ট্যান্ডেম এক্স' ও তার যমজ ভাই ‘টেরাসার এক্স' ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে৷ ‘টেরাসার এক্স' ২০০৭ সাল থেকেই মহাকাশ থেকে তথ্য পাঠিয়ে চলেছে৷ প্রায় সাড়ে আট কোটি ইউরো ব্যয় করে এই স্যাটেলাইট তৈরি হয়েছিল৷ এবার ‘ট্যান্ডেম এক্স' তার সঙ্গী হওয়ার ফলে তাদের যৌথ শক্তি নতুন মাত্রা পেয়েছে৷ গোটা প্রকল্পের জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৬.৫ কোটি ইউরো৷ জার্মান মহাকাশ সংস্থা ডিএলআর ও ‘অ্যাস্ট্রিয়াম' নামের এক বেসরকারী সংস্থা মিলে এই প্রকল্প শুরু করেছে৷ ‘অ্যাস্ট্রিয়াম' প্রকল্পের এক চতুর্থাংশ ব্যয়ভার বহন করছে৷ ২১শে জুন ১.৩ টন ওজনের এই স্যাটেলাইট কাজাকস্তানের বৈকানুর মহাকাশ কেন্দ্র থেকে রাশিয়ার একটি রকেটের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হয়৷ মাত্র সাড়ে তিন দিনের মধ্যেই প্রথম সঙ্কেত আসতে শুরু করে দিয়েছে৷ সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে মাদাগাস্কার দ্বিপের উত্তরাংশ, ইউক্রেন ও মস্কো শহরের ছবি দেখা যাচ্ছে৷ তবে এই সব তথ্য মূলত পরীক্ষামূলক হিসেবেই গণ্য করা হচ্ছে৷ ছবির মান যাতে সন্তোষজনক হয়, নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে তা নিশ্চিত করা হচ্ছে৷ প্রাথমিক স্তরে দুটি স্যাটেলাইটের কক্ষপথ আলাদা৷ ধাপে ধাপে তাদের মধ্যে সমন্বয় আনা হচ্ছে৷
মিউনিখের কাছে ছোট একটি শহরের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে তাদের কাজকর্মের উপর নজর রাখা হচ্ছে৷ ৩ বছর ধরে ভূপৃষ্ঠের সম্পূর্ণ এলাকার ছবি তুলে যাবে এই দুই স্যাটেলাইট৷ ৫১৪ কিলোমিটার উপরে এক কক্ষপথে ঘণ্টায় প্রায় ২৮,০০০ কিলোমিটার গতিতে পরস্পরের মধ্যে মাত্র দু'শো মিটার ব্যবধান বজায় রেখে তারা একই এলাকার ছবি তুলে যাবে – বা আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে রাডার যন্ত্রের মাধ্যমে যে কোনো এলাকার উঁচু-নিচু সব খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্য ক্যামেরাবন্দি করবে৷ আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলেও রাডার যন্ত্র কাজ করতে পারে৷ ফলে আবহাওয়ার পরোয়া না করেই কাজ করে যেতে পারবে এই দুই স্যাটেলাইট৷ ত্রিমাত্রিক ক্যামেরার যেমন দু'টি করে লেন্স থাকে, যাদের মধ্যে সামান্য ব্যবধানের ফলেই ত্রিমাত্রিক ছবি তোলা সম্ভব – ঠিক সেভাবেই দুটি স্যাটেলাইটের মধ্যে নির্দিষ্ট ব্যবধান বজায় রেখে পৃথিবীর ছবি তোলা হচ্ছে৷ মানুষের দুটি চোখও ঠিক একইভাবে কাজ করে৷ ফলে আমরা আশেপাশের যে কোনো বস্তুর দূরত্ব সঠিকভাবে আন্দাজ করতে পারি৷
ত্রিমাত্রিক তথ্যভান্ডার
‘ট্যান্ডেম এক্স' ও ‘টেরাসার এক্স'এর পাঠানো তথ্য এসে পৌঁছচ্ছে মিউনিখের কাছে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে৷ সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে ক্রমশঃ গড়ে উঠছে পৃথিবীর প্রথম নির্ভরযোগ্য ত্রিমাত্রিক মডেল৷ ভৌগোলিক বা অন্য কোনো সীমানার পরোয়া করে না স্যাটেলাইটের ক্যামেরা৷ অত্যন্ত সূক্ষ্ম সেই ছবি৷ ভূপৃষ্ঠের ৫১৪ কিলোমিটার উপর থেকেও এত স্পষ্ট ছবি তোলা হচ্ছে, যে মাত্র ৫ মিটারের তফাতও তাতে ধরা পড়ে৷ অর্থাৎ চলন্ত ট্রেনের ছবিও ধরা পড়বে স্যাটেলাইটের চোখে৷ এই প্রকল্প থেকে যে ডিজিট্যাল তথ্য সংগ্রহ করা হবে, তার পরিমাণ হবে প্রায় ১.৫ পেটাবাইট৷ ১ পেটাবাইট হলো ১,০০০ টেরাবাইট বা ১০ লক্ষ গিগাবাইট৷ সাধারণ ডিভিডির মধ্যে সেই তথ্য পুরলে এবং সেই সব ডিভিডি একে অপরের উপর রাখলে সেই স্তুপের উচ্চতা হবে প্রায় ৪৩০ মিটার৷
প্রয়োগের সম্ভাবনা
পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক মডেলের কার কাজে লাগে পারে? ভূ-তাত্ত্বিকদের কাছে এমন এক মডেল স্বপ্নের মতো৷ তাঁরা যে এই তথ্য পুরোপুরি কাজে লাগাবেন, তা বলাই বাহুল্য৷ তবে এর প্রয়োগ এখানেই সীমিত নয়৷ শহর এলাকার পরিকল্পনা, জমির ব্যবহার, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলার মতো কাজেও ত্রিমাত্রিক মডেল অত্যন্ত কাজে লাগতে পারে৷ সমুদ্র সম্পর্কে গবেষণার ক্ষেত্রেও মূল্যবান তথ্য পাওয়া যেতে পারে৷ প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজেও ত্রিমাত্রিক মানচিত্র কাজে লাগানো হবে৷ সামরিক অভিযান অথবা বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে ত্রাণ পৌঁছনোর সময় এই তথ্য কাজে লাগবে৷ শুধু সরকার, প্রশাসন বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নয় – বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই তথ্য ব্যবহার করা যেতে পারে৷ ইতিমধ্যেই ৩০টি সংস্থা এবিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে৷ ফলে এই ত্রিমাত্রিক মডেলের চাহিদা যে বিশাল হতে চলেছে, এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ অদূর ভবিষ্যতে গাড়ির ন্যাভিগেশন যন্ত্রের মধ্যেও হয়তো স্থান পাবে এই তথ্য৷ গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই পথ সম্পর্কে আগাম ও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে৷
জার্মান মহাকাশ সংস্থা ডিএলআর'এর কাছে এই প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ অন্য যে কোনো প্রকল্পের মতো এক্ষেত্রেও মূল উদ্দেশ্য বিজ্ঞানের ক্ষমতার প্রসার হলেও এই প্রকল্পের ব্যবহারিক দিক এতটাই বহুমুখী, যে মহাকাশ অভিযানের সার্থকতা সব স্তরের মানুষের কাছেই অত্যন্ত স্পষ্ট৷ তাছাড়া তথ্যের বাণিজ্যিক বিপণনের মাধ্যমে মহাকাশ সংস্থা কিছু আয়ও করতে পারবে, যা অর্থনৈতিক সঙ্কটের এই যুগে মোটেই ফেলনা নয়৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা. আব্দুল্লাহ আল ফারূক