পুলিশ হেফাজতে ব্যবসায়ীর মৃত্যুর অভিযোগ,পুলিশ বলছে ‘সব রটনা'
২০ জানুয়ারি ২০২৩ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল থেকে বুধবার মধ্যরাতে ৪০ বছর বয়সি রবিউলের মরদেহ পুলিশ হস্তান্তর করেছে বলে জানান নিহতের শ্যালক মো. রাকিবুল৷ বৃহস্পতিবার সকালে রংপুরের পীরগঞ্জে তার গ্রামের বাড়িতে ওই ব্যবসায়ীর মরদেহ দাফন করা হয়৷
রাতে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল ছাড়ার কথা জানিয়ে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মো. রাকিবুল বলেন, লাশ অ্যাম্বুলেন্সে তোলা থেকে শুরু করে অনেকটা পথ পুলিশ পাহারা দিয়ে এগিয়েও দেয়৷
পুলিশ হেফাজতে এ ব্যবসায়ীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠার পর বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর বিক্ষোভ ও ভাংচুরের প্রেক্ষাপটে ঘটনার তদন্তে কমিটি গঠন করা হলেও ‘ময়নাতদন্ত ছাড়াই' লাশ হস্তান্তরের বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না পুলিশ কর্মকর্তারা৷
এমন ঘটনায় ময়নাতদন্ত না করেই লাশ হস্তান্তরের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেছেন, যে ঘটনায় পুলিশের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে তা এভাবে হস্তান্তর করায় নানা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক৷ স্বজনদের সম্মতির পরও 'লাশটা এভাবে দেওয়া ঠিক হয়নি' বলে মনে করেন তিনি৷
গত শনিবার রাতে গাজীপুরের বাসান থানাধীন এলাকায় অনলাইনে জুয়া খেলার অভিযোগে ওই ব্যবসায়ীসহ চারজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর মঙ্গলবার রাতে তার মৃত্যুর খবর পান স্বজনরা৷ তাদের জানানো হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার পর তার মৃত্যু হয়৷
এ সংবাদে বুধবার সকালে গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে মহাসড়ক অবরোধ করে নিহত রবিউলের স্বজন ও এলাকাবাসী বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করে৷ পরে মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে গাজীপুর মহানগর পুলিশ তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে৷
এ ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা তৈরির পর তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম মৃত্যুর কারণ জানতে ময়নাতদন্তের কথা বলেছিলেন৷
বুধবার তিনি বলেন, “পোস্ট মর্টেমের আগে মৃত্যুর কারণ বলা যাবে না৷ রবিউলের মৃত্যুতে যদি কোনো পুলিশের অবহেলা থাকে বা অপরাধী হয় তবে সে যে-ই হোক তার বিচার হবে৷”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বিনা ময়নাতদন্তে লাশ হস্তান্তর কিংবা ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানোর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে শাহবাগ থানার পুলিশ৷ এ থানার ওসি নূর মোহাম্মদও স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না আবার গাজীপুর মহানগর পুলিশও এর কোনো দায় নিচ্ছে না৷
পেশায় সুতা ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার শাহজাদপুর গ্রামের আব্দুল বাকীর ছেলে৷ তিনি গাজীপুর মহানগরের বাসন থানার ভোগরা বাইপাস পেয়ারাবাগান এলাকায় ভাড়া থাকতেন৷
অনলাইনে জুয়া খেলার অভিযোগে শনিবার তাকেসহ চারজনকে ধরে নিয়ে যায় বাসন থানার দুই এসআই৷ এরপর তিনজনকে ছেড়ে দিলেও রবিউলের খোঁজ পাননি স্বজনরা৷
তিন দিন পর বুধবার ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে তার মৃত্যুর খবর পান স্বজনেরা৷ পুলিশের দাবি, তাকে ছেড়ে দেওয়ার পর গাড়িচাপায় আহত হয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন৷
রবিউলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রথমে গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস সড়কের ঢাকা-টাঙ্গাইল অংশে এবং পরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে এলাকাবাসী৷
এক পর্যায়ে তারা ওই মহাসড়কে চারটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ভোগড়া বাইপাস মোড়ে পুলিশ বক্সে ভাঙচুর চালায় পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে৷
তবে থানা বা পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ অস্বীকার করে রবিউলের মৃত্যুর বিষয়ে বাসন থানার ওসি মালেক খসরু খান সাংবাদিকদের বলেন, “থানার দুই এসআই রবিউলকে আটক করে থানায় নিয়ে এসেছিল৷ পরে তার স্বজন ও স্থানীয়দের আবেদন এবং তিনি ভালো লোক সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাতে ছেড়ে দেওয়া হয়৷
“স্থানীয় লোকজন তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি গাড়িচাপায় গুরুতর আহত হন৷ স্বজনরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয়৷ তবে স্বজন ও এলাকাবাসী রটান যে রবিউল পুলিশ হেফাজতে মারা গেছেন৷”
ঢাকা মেডিকেল থেকে দেওয়া মৃত্যুর সনদপত্রে মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ হিসেবে ‘সড়ক দুর্ঘটনা' লেখা থাকলেও মৃতদেহের ময়নাতদন্ত প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়৷
মঙ্গলবার রাতে মৃত্যু হলেও বুধবার সারাদিন রবিউলের লাশ হাসপাতালেই পড়েছিল৷ এরপর মধ্যরাতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা৷ রংপুরের পীরগঞ্জে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তার দাফন হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিহতের শ্যালক রাকিবুল৷
ময়নাতদন্ত: জানা নেই পুলিশের
এদিকে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিতে শাহবাগ থানার ওসি বরাবর বুধবার লিখিত আবেদন করেছিলেন নিহতের ভাই মহিদুল ইসলাম৷ ওই আবেদনে মৃত্যুর কারণ হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলা হয়৷
আবেদনে বলা হয়, “মঙ্গলবার মধ্যরাতে বাসন থানা থেকে তার ভাই রবিউল বাইপাস পেয়ারা বাগানে ফেরার সময় ট্রাকের ধাক্কায় আহত হলে হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান৷ এ ব্যাপারে কারো বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই৷ তিনি তার ভাইয়ের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়া নিয়ে যেতে চান৷”
সেক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত ছাড়া রবিউলের লাশ হস্তান্তর শাহবাগ থানা পুলিশ করেছে কি না- সেই প্রশ্নে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি ওই থানার ওসি নূর মোহাম্মদ৷
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা মহানগরের বাইরের কোনো থানা এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মেডিকেলে কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে তারা শাহবাগ থানায় চিঠি লিখে, তাদের প্রতিনিধি হয়ে শাহবাগ থানা কাজটা করে দেয়৷ এটা তাদেরই কাজ, তাদের প্রতিনিধি হয়ে আমরা করে দিই আর কি৷”
তাহলে বিনা ময়নাতদন্তে লাশ আপনারাই হস্তান্তর করেছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি সরাসরি কিছু বলেননি৷
ওসি বলেন, “আচ্ছা আমি কথা বলে দেখি লাশটা কোথায়, কালকে তো লাশের পোস্টমর্টেম হয়নি৷” স্বজনদের বরাতে বুধবার রাতে লাশ রংপুরে নিয়ে যাওয়ার তথ্য জানালে তিনি বলেন, “আচ্ছা আমি কথা বলে জানার চেষ্টা করছি৷”
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেডিকেলের এক কর্মী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বাসন থানার এসআই সুকান্ত বাবু নিহতের ভাই মুহিদুলের কাছে লাশ হস্তান্তর করেন৷ তবে এসআই সুকান্ত বিষয়টি অস্বীকার করেন৷
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুকান্ত বাবু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনি কার কাছ থেকে জানলেন, আমি তো এ বিষয়ে কিছুই জানি না৷”
ব্যবসায়ী রবিউলের মৃত্যু ও মহাসড়ক আটকে এলাকাবাসীর ভাঙচুরের পর ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করেছে গাজীপুর মহানগর পুলিশ৷ কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে৷
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন মনে করেন পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার পর মৃত্যু এবং এলাকাবাসীর বিক্ষোভ-ভাঙচুরের পর ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ হস্তান্তর করা ঠিক হয়নি৷
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যেখানে পুলিশকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এই মৃত্যুর সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে- এরকম একটা মৃত্যুর ক্ষেত্রে স্বজনদের সম্মতি হলেও লাশটা এভাবে দেওয়া ঠিক হয়নি৷”
তার ভাষ্য, “এতে সাধারণ মানুষের ভেতর একটা ধারণা জন্মায় যে, পুলিশ তাদের বাধ্য করেছে বিনা ময়নাতদন্তে লাশ গ্রহণের জন্য৷ এক্ষেত্রে অবশ্যই ময়নাতদন্ত করাটা জরুরি ছিল৷”
‘ভেজালে পড়তে চান না' স্বজনরা
রবিউলের লাশ পুলিশ পাহারায় ঢাকা মেডিকেল থেকে বের করার পর রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় তার গ্রামে পাঠানো হলে বৃহস্পতিবার সকালে সেখানেই তার দাফন হয়৷ তার শ্যালক রাকিবুল ইসলাম ঢাকার শ্যামলী এলাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন৷ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার রাতে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়৷ হাসপাতাল থেকে পুলিশ সদস্যরা পাহারা দিয়ে লাশ অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়৷ সকালে জানাজা শেষে দাফন করা হয়েছে৷
এখন এ নিয়ে আর কোনো অভিযোগ তুলতে চান না জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা কেউ আর কোনো ভেজালে যেতে চাচ্ছি না৷ তাকে তো ফিরে পাওয়া যাবে না৷ এখন এইটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করলে হয়ত আপনাদেরও যেমন দৌড়াতে হবে, ফ্যামিলিকেও তেমন দৌড়াতে হবে৷ যে অভিযোগ করবে তাকেও দৌড়াতে হবে৷”
নিহতের চাচাত ভাই স্বপন এবং আপন ভাই মহিদুলও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি৷
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) আবু তোরাব মো. শামসুর রহমান বলেন, “নিহতের পরিবার সড়ক দুর্ঘটনার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেছেন৷ এছাড়া পুলিশের ক্ষতিসাধন করায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে৷”
এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)