পুরুষদের ‘যুদ্ধ’ এড়াতে সাহায্য রুশ নারীবাদীদের
২৩ অক্টোবর ২০২২২১ সেপ্টেম্বর মস্কো যখন সামরিক সংহতি অভিযান ঘোষণা করেছিল তখন নারী আন্দোলন কর্মী লিলিয়া ভেজিয়েভাতোভার ঘুম উড়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েকজন বন্ধু তাকে বলেন, পুরুষদের রাশিয়া ছেড়ে যেতে সাহায্য করতে হবে। ভেজিয়েভাতোভা নিজে আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে থাকেন এবং "নারীবাদী যুদ্ধবিরোধী প্রতিরোধ" গোষ্ঠী বা এফএএসের একজন সমন্বয়কারীও তিনি।
রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুটিন সম্প্রতি জানান, আংশিক সংঘবদ্ধকরণের অংশ হিসাবে ইতিমধ্যেই দুই লাখ ২২ হাজারের বেশি লোককে যুদ্ধে যোগ দিতে ডাকা হয়েছে। এ কথা আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ায় বলা হয়। কিন্তু এর ফলে দেশ ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকেও প্ররোচনা দেয়া হয়েছে।
স্বাধীন রাশিয়ান সংবাদপত্র নোভায়া গেজেটা ইউরোপের মত, দুই লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি পুরুষ যুদ্ধে যোগ দেয়া এড়াতে দেশ ছেড়েছেন। ফলে নারীবাদী যুদ্ধবিরোধী প্রতিরোধ গোষ্ঠীও নতুন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ভেজিয়েভাতোভা ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘আমরা পরামর্শ দিয়েছি, টিকিট কিনেছি, বাসের ব্যবস্থা করেছি এবং মানুষের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করেছি। বেশিরভাগ পুরুষ ২১ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন।''
রাশিয়া এবং বিদেশের কয়েক শতাধিক এফএএস কর্মী এই কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ৬০ জন পুরুষকে রাশিয়া ছেড়ে যেতে সহায়তা করেছেন।
উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের আগে স্থানান্তর
এফএএস অ্যাক্টিভিস্ট ললিয়া নর্ডিক বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে কয়েকজন যোগাযোগ করেছিলেন যারা রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদান না বরং পালাতে চেয়েছিলেন বা আত্মীয়দের সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। তাদের মানবাধিকার সম্পর্কে জানিয়েছি। আমি প্লেনের টিকিট কিনলাম, অস্থায়ী আবাসনও দেখলাম।''
ভেজিয়েভাতোভা বলেন, রাশিয়া থেকে প্রথমে ট্রান্সজেন্ডার বা প্রতিবাদের কারণে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়া দরকার। সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন তারা। আশঙ্কা ছিল, নিরাপত্তা বাহিনী খসড়া নোটিশ নিয়ে তাদের বাড়ি থেকে নিতে আসবে।"
তিনি জানান, সাহায্যকারীরা রাশিয়া-জর্জিয়া সীমান্তে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ একাধিক ব্যক্তিকে নিয়ে এসেছিল। অ্যাক্টিভিস্টদের ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে রাখা হয়েছিল। ভেজেভাতোভা বলেন, ‘‘নারীরা এখন রাশিয়ান নাগরিক সমাজের ভিত্তি তৈরি করেছে। তারা দ্রুত বাহিনীতে যোগদান করে কার্যকর সহায়তা প্রদান করে।''
আইনি, মনস্তাত্ত্বিক এবং বাস্তবিক সহায়তা প্রদান
নাটালিয়া কোভিলিয়ায়েভা জানান, এফএএস হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যা রাশিয়ায় নারীবাদী আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। এস্তোনিয়ার টারতু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, বছরের শুরুতে রাশিয়ার ৩০টি অঞ্চলে প্রায় ৫৭টি নারীবাদী দল ছিল । ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি অনেকেই এফএএস গঠনের জন্য একত্রিত হন। বর্তমানে এই আন্দোলন রাশিয়া ও বিদেশ মিলে ১০০টি শহরে সক্রিয়।
টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপে এফএএস-এর বর্তমানে ৪০ হাজারের বেশি ফলোয়ার রয়েছে। এর সদস্যরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করে। রাস্তায় কালো পোশাক পরে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে যুদ্ধবিরোধী মিম ছড়িয়ে দেয়। এমনকি, ব্যাংকনোটে "নো টু ওয়ার" লিখে প্রতিবাদ করে এবং ঝেনস্কায়া প্রাভদা (নারীদের সত্য) নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করে।
টুইটারে তারা বলে, ঝেনস্কায়া প্রাভদা একটি স্বাধীন যুদ্ধবিরোধী সংবাদপত্র যা আমাদের মা এবং দাদিদের ছাপানো। পাঠকেরা সংবাদপত্রটি ডাউনলোড করেও পড়তে পারে।
এফএএস কর্মীরা পূর্ব ইউক্রেনীয় শহর মারিউপোলে হতাহতদের ব্যক্তিদের স্মরণে বাড়ির উঠানে শত শত স্মারক স্থাপন করেছে।
কোভিলিয়ায়েভা বলেন, "নারীবাদীরা পলাতকদের আইনি, মনস্তাত্ত্বিক এবং বাস্তবিক সহায়তা দিচ্ছে। তাদের স্থানান্তরে সাহায্য করছে। "
নারীবাদী রাজনৈতিক শক্তি
আন্দোলনের একটি সাংগঠনিক কাঠামোও রয়েছে এবং কর্মীরা যেকোনো শহরে তাদের নিজস্ব ফেডারেশন গঠন করতে পারে। এফএএসকে আরো খাপ খাইয়ে নেয় এবং নতুন কৌশলের জন্য অনুমতি দেয় এই কাঠামো। কোভিলিয়ায়েভা বলেন, "হাইড্রার বেশ কয়েকটি মাথা আছে, এবং আপনি যদি একটি কেটে ফেলেন তবে ১০টি নতুন মাথা ফিরে আসবে।"
তিনি জানান, প্রতিবাদের সৃজনশীল ধারাগুলির কারণে অন্যান্য উদ্যোগের তুলনায় এফএএসও আলাদা। "নারীবাদীরা মানুষকে সবকিছু বোঝায় সহজ ভাষায়। যুদ্ধ এবং তার পরিণতিগুলিকে এমন ভাষায় বোঝাচ্ছে যে জনসংখ্যার বড় অংশ সেটি বুঝতে পারছে।"
সমাজে রুশ নারীবাদীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সবসময়ই খুব নেতিবাচক ছিল। এক সদস্য বলেন, কিছু অগ্রগতি হয়েছে। এখন মনোভাব কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তা বলা কঠিন, তবে নারীবাদীরা জনসংখ্যার বৃহৎ অংশের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন।"
কোভিলিয়ায়েভার মতে, এফএএস যুদ্ধ, পিতৃতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদ এবং সামরিকবাদ বিরোধী একটি বাস্তব রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, পুটিনের শাসন অন্যান্য বিরোধী শক্তিকে চূর্ণ করেছে। তবে বিরোধী রাজনীতিবিদসহ কেউই নারীবাদীদের গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু নারীবাদীরা ধীরে ধীরে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, তিনি বলেন।
তথ্যের উপর গুরুত্ব
অনেক নারীবাদী কর্মী রাশিয়া ত্যাগ করেছেন কারণ তারা ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের পরে হাজতবাস করেছেন। কারাবাসের হুমকি থেকে বাঁচতে চেয়ে দেশ ছেড়েছেন তারা।
মার্চ মাসে আর্মেনিয়ার রাজধানীতে যাওয়ার আগে এফএএস সমন্বয়কারীকে দুই বার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে তিনি বলেন, নির্বাসনে থাকা কর্মীরা আরো নিরাপদে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছে।
যুদ্ধে যোগদানের জন্য খসড়া নোটিশের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। তারা রাশিয়ানদের দেয়া তথ্যের দিকে মনোনিবেশ করেছে। তাদের সরকারের নোটিস গ্রহণ না করার এবং নিয়োগ অফিস থেকে দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে এটি একটি কঠিন পরিস্থিতি। ভেজিয়াতোভা বলেন, এতে পুরুষদের লিঙ্গপরিচয়ের গভীর ভূমিকা রয়েছে। এমনকি কয়েকজন মা তাদের ছেলেদের বলে, যুদ্ধে না যাওয়ার অর্থ তারা কাপুরুষ।
তিনি জানান, অনেক পুরুষ এবং নারীরও সমাজে নারীবাদীদের প্রতি দুর্বল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তবে মানুষ যখন প্রয়োজনে পড়ে এবং মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ায়, তখন তাদের অতীত আচরণের কথা মনে করিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। রাশিয়া থেকে আমরা যে সমস্ত পুরুষদের নিয়ে এসেছি তাদের প্রত্যেকের মা, স্ত্রী, বোন এবং সন্তান রয়েছে।
আরকেসি/ইরিনা চেভতাইয়েভা/আরকেসি
প্রতিবেদনটি প্রথম রুশ ভাষায় প্রকাশিত