1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গে শিশুদের জন্য বাজেটের অভাব!

পায়েল সামন্ত কলকাতা
৩১ জানুয়ারি ২০১৯

কলকাতায় শেষ হলো শিশুদের চলচ্চিত্র উৎসব৷ দর্শকরা ভালো চলচ্চিত্র দেখার আনন্দ পেয়েছে এ উৎসবে৷ তবে ‘‘উৎসবের প্রচার আরো হওয়া দরকার৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে রাজ্যে সেই তুলনায় দুর্গাপুজোর প্রচার বেশি হয়’’ - এমন কথাও শোনা গেছে৷

https://p.dw.com/p/3CUve
ছবি: DW/S. Payel

শিশু-কিশোরদের জন্য ৩৫টি দেশের ২১৯টি বিশ্বমানের চলচ্চিত্র দেখানো হয়ে গেল কলকাতায়৷ ২০ থেকে ২৭ জানুয়ারি নন্দন, শিশির মঞ্চ, রবীন্দ্র সদন, স্টার থিয়েটার, রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবন, অহীন্দ্র মঞ্চ ও রবীন্দ্র তীর্থ নিয়ে মোট ৯টি প্রেক্ষাগৃহে ছিল বিশ্বের একগুচ্ছ ছোটদের চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী৷ ১৬টি বিভাগে দেখানো এই ছবিগুলি ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড, অ্যামেরিকা, ইটালির মতো দেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা দেশের পাশাপাশি ইসরায়েল, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ব্রাজিল থেকেও আনা হয়েছে৷ বাদ যায়নি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানও৷

এই ছবিটি বাংলাদেশের বলেই বাড়তি আগ্রহ: সায়রীর মা

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র

বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে খুদে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের আনাগোনা দেখা গিয়েছে৷ অনুষ্ঠানে অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের তিনটি সিনেমাও যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে৷ কেষ্টপুরের খুদে দর্শক সায়রী গুপ্ত শিশির মঞ্চ থেকে বেরোলো ‘খেলা হল খুলনায়’ সিনেমাটি দেখে৷ একগাল হাসি নিয়ে সে ডয়চে ভেলেকে বলল, ‘‘সিনেমা ভালোই লেগেছে৷ মা আর দিদার সঙ্গে সিনেমা দেখতে এসেছি৷’’ সায়রী যে সিনেমাটা দেখেছে, সেটা যে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের ছবি, সেটা সে ভালোই জানে৷ সায়রীর মা বললেন, ‘‘এই ছবিটি বাংলাদেশের বলেই বাড়তি আগ্রহের৷ গল্পটিও বেশ শিক্ষণীয়৷ ডিজিটাল গোয়েন্দাগিরি নিয়ে একটা ধারণা পেলাম৷ আবার বাংলাদেশের ছবি দেখার আগ্রহ আছে৷ ঠিক কতগুলো বাংলাদেশের ছবি এসেছে জানি না৷’’

এই ছবিটি ছাড়াও বাংলাদেশের আরো তিনটি ছবি এসেছে এই চলচ্চিত্র উৎসবে— আশরাফ শিশিরের ‘গাড়িওয়ালা’, সুমন ধরের ‘অমি ও আইসক্রিমঅলা’ এবং মোর্শেদুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’৷ বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘এটা বাংলাভাষীদের উৎসব বলেই বাংলাদেশের ছবি খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ আগামী দিনে আরো ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া উচিত ওপারের বাংলা ছবি নিয়ে আসার ক্ষেত্রে৷’’

শিশু দর্শকরা যা বললো

‘এটা শুধু ছোটদের ভালো ছবি দেখানোর প্রদর্শনী'

‘অষ্টম কলকাতা আন্তর্জাতিক শিশু কিশোর চলচ্চিত্র উৎসব’-এর আহ্বায়ক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ যাবৎ ২০১৯-এর এই চলচ্চিত্র উৎসবই সবচেয়ে বড়৷ ভারতে যে দুটি শিশু চলচ্চিত্র উৎসব হয়, তার মধ্যে হায়দ্রাবাদের তুলনায় কলকাতার উৎসব অনেক বড় মাপের৷'' কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র, তথা বাংলা সংস্কৃতির আরেক পীঠস্থান বাংলাদেশের মাত্র চারটি ছবি কেন? ছবি নির্মাণের নেপথ্যের কাহিনি তুলে ধরার জন্য কোনো পরিচালক বা শিল্পীও নেই কেন? শিশু কিশোর অ্যাকাডেমির সম্পাদক শেখর বলেন, ‘‘আসলে বিভিন্ন দেশের হাই কমিশনের কাছে আমরা সরকারিভাবে ছবি চেয়ে থাকি৷ এবার বাংলাদেশ থেকে ছবি এসে পৌঁছতে দেরি হয়েছে৷ ফলে সব ছবি আমাদের উৎসবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি৷ আর বাংলাদেশ থেকে এবার কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি৷’’ শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, অন্যবার বাংলাদেশের ছবি আরো থাকে৷ তবে শুধু বাংলাদেশ কেন, নিয়মিতভাবে কোনো দেশেরই পরিচালক বা শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানোর পর্ব এই উৎসবে নেই৷ একইরকমভাবে নেই পুরস্কার প্রদানের ধারাটিও৷

চলচ্চিত্র পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এ ব্যাপারে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাধারণভাবে চলচ্চিত্র উৎসব বলতে যা বুঝি, এই শিশু চলচ্চিত্র উৎসবকে তার সঙ্গে তুলনা করলে বোধ হয় ঠিক হবে না৷ এটাকে ছোটদের ভালো ছবি দেখানোর একটা প্রদর্শনী বলা ভালো৷ কাজেই একইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের পরিচালক বা শিল্পীদের এখানে আশা করা যাবে না৷’’

ভারতে যে দুটি শিশু চলচ্চিত্র উৎসব হয়, তার মধ্যে কলকাতার উৎসব অনেক বড়৷ শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়

বাজেট অল্প?  

বর্ষীয়ান ও বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক নির্মল ধর বলেন, ‘‘চলচ্চিত্রের জন্য খুব দরকার দর্শকের সঙ্গে পরিচালক বা শিশুশিল্পীর মুখোমুখি হওয়াটা৷ তাহলে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ আমাদের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের যে ছবি হয়, তার পরিচালকরা না এলেও শিশুশিল্পীদের আসা এখানে খুব দরকারি৷’’

উৎসব কমিটির সূত্রে জানা গেল, উৎসবের উদ্বোধনী ছবি ছিল তিনটি জাতীয় পুরস্কারজয়ী ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘ওয়াকিং উইথ দ্য উইন্ড’৷ এই উৎসবের শুভ সূচনা করেছে এই চলচ্চিত্রের শিশু অভিনেতা লাদাখের বাসিন্দা সোনম ওয়াঙ্গিয়াল৷ সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পরিচালক প্রবীণ মোর্ছলেও৷  

কিন্তু শুধু উদ্বোধনী ছবির ক্ষেত্রে কেন? সব ছবিগুলির ক্ষেত্রে তা নয় কেন? শেখর বলেন, ‘‘বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনের মাধ্যমে ছবিগুলি আনানো হয় বলে ছবির জন্য আমাদের খরচ করতে হয় না৷ শুধু আনুষঙ্গিক খরচ করতে হয়৷ তাই সে অর্থে যে প্রচুর টাকা আমরা ব্যয় করি, তা নয়৷ সে-ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের পরিচালকদের আনতে হলে বাজেটে সম্ভব হবে না৷ আমরা অল্প বাজেটেই শুরু করেছিলাম৷ সেভাবে চলতে চলতে আজ এত বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি৷’’

এটা বাংলাভাষীদের উৎসব বলেই বাংলাদেশের ছবি খুব গুরুত্বপূর্ণ: কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়

‘দেখা যাচ্ছে সেই তুলনায় রাজ্যে দুর্গাপুজোর প্রচার বেশি হয়’ 

উৎসবে উপস্থিত সায়রীর মায়ের মতো আরো অনেক অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, এই চলচ্চিত্র উৎসবের প্রচার সেই অনুযায়ী হয় না৷ কথাটা একবাক্যে স্বীকার করলেন শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রচার বেশি হলে ভালো হতো৷ কিন্তু আমাদের এ ব্যাপারে সংযত থাকতে হয়৷ তার কারণ, হলগুলিতে আসন সংখ্যা সীমিত৷ তবে স্কুল পড়ুয়ারা এসেছে দল বেঁধে৷ বিভিন্ন হল হাউসফুল হয়েছে৷’’

আজকাল বাচ্চাদের হাতে যেভাবে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন উঠে এসেছে, তাতে শৈশব ক্ষতিগ্রস্ত৷ সত্যি বলতে ছোটদের কথা মাথায় রেখে সেভাবে ছবি নির্মাণ হয় কোথায়? সেখানে শিশুদের জন্য ভালো চলচ্চিত্রের সান্নিধ্য ছোটদের খুবই দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ চলচ্চিত্র অনুরাগী দর্শক কৌশিক দাস বললেন, ‘‘একসঙ্গে ভালো ছবি দেখার সুযোগ কোথায়? সে জন্যই এই উৎসবের প্রচার আরো হওয়া দরকার৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেই তুলনায় রাজ্যে দুর্গাপুজোর প্রচার বেশি হয়৷’’

চলচ্চিত্র পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় অবশ্য মানুষের সচেতনতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘নিঃসন্দেহে প্রচার আরো থাকলে ভাল হতো৷ তবে আমাদের দেশে ফিল্ম নিয়ে সচেতনতা কোথায়? ফিল্ম দেখার মানে, বিশেষ করে ছোটদের ফিল্ম দেখার তাৎপর্য সাধারণ মানুষ কতটা বোঝে? তাই এ ব্যপারে সচেতনতা বাড়ানো আরো দরকার৷’’

বাস্তবিকই শিশুদের ভালো সিনেমামুখী করে তুলতে গেলে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া দরকার৷ কিন্তু সেই সচেতনতা তৈরি করতে হবে সমাজকেই৷ সে জন্যই বেশি প্রচারের গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করেন নির্মল ধর৷ তিনি বলেন, ‘‘কর্তৃপক্ষের একটু ভাবা উচিত প্রচার নিয়ে৷ অন্তত একমাস আগে গুরুত্ব দিয়ে এই প্রচারটা করতে হবে৷ যে উদ্দেশ্যে কাজটা হচ্ছে, সেটা সফল করতে রাখতে হবে প্রচারের আলাদা বাজেট৷ নইলে উদ্দেশ্য মাটি হয়ে যাবে৷ রাজ্য সরকারের উদ্যোগে যখন হচ্ছে, তাদেরই প্রচারের ব্যাপারটা তাদেরই সচেতনভাবে ভাবতে হবে৷’’ 

তবে যেখানে দুর্গাপুজোয় ক্লাবে অনুদান দেওয়া হয়, খেলাধুলোর জন্য যেখানে রাজ্যের ৪ হাজার ৩০০ ক্লাবকে ২ লক্ষ টাকা করে অনুদান দেওয়া হচ্ছে, সেখানে এই মননশীল শিশু উৎসবের জন্য দেখা যাচ্ছে বাজেট ঘাটতি৷ শিশুদের কাছে বৃহত্তর জগতের ভাবনা ও বার্তা পৌঁছে দিতে সরকার আরো উদারহস্ত হবে না কেন?