পরিযায়ী পাখির স্বর্গ টাঙ্গুয়ার হাওর
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর৷ ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ের কোলে বিশাল এ জলাভূমি পাখিদের জন্য যেন এক স্বর্গ৷
নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল
স্থানীয়রা টাঙ্গুয়ার হাওরকে বলেন ‘নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল’৷ সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুরের দশটি মৌজার ছোট-বড় ১২০টি বিল নিয়ে এ হাওরের বিস্তৃতি৷ দুই উপজেলার ৪৬টি গ্রামসহ পুরো টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে ২ লক্ষ ৮০ হাজার ২৩৬ হেক্টরই জলাভূমি৷
টাঙ্গুয়ার হাওরের পাখি
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খানের মতে, টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখি আছে প্রায় ২৫০ প্রজাতির৷ এসব পাখির বড় একটি অংশই পরিযায়ী পাখি৷ টাঙ্গুয়ার হাওরের মতো এত বেশি পরিযায়ী পাখি দেশের অন্য কোথাও দেখা যায় না৷
পাখির অভয়ারণ্য
টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রধান দুটি পাখির অভয়ারণ্য হলো লেউচ্ছামারা ও বেরবেড়িয়ার বিল৷ এছাড়াও যে বিলগুলোতে পাখিদের আনাগোনা বেশি থাকে, সেগুলো হলো রৌয়ার বিল, গজারিয়ার বিল, আলমের ডোয়ার, সাংসার বিল, কৈখালি বিল, ছুনখোলা বিল, জিততলার গোপ, ফইল্লার বিল, রূপাভুই বিল, সত্তার বিল, মইষের গাতা, হাতির গাতা, বালোয়ার ডোবা, আমছারের বিল, কাউয়ার বিল, আনসারের বিল, খাজুরী বিল, আইন্নার বিল, নলকাঠির বিল ইত্যাদি৷
পাখি দেখা
শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিযায়ী পাখিরা দল বেঁধে টাঙ্গুয়ার হাওরে আসতে শুরু করে৷ এ হাওরে তাই পাখি দেখার সবচেয়ে ভালো সময় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি৷
তাঁবু বাস
শীত মৌসুমে পাখি দেখতে টাঙ্গুয়ার হাওরে ছুটে যান পাখিপ্রেমী মানুষেরা৷ নানান পাখির ছবি তুলতে জায়গাটিতে অনেকেই তাঁবুতেও বাস করেন৷
লালঝুঁটি-ভুতিহাঁস
পাখিটি রাঙ্গামুড়ি নামেও পরিচিত৷ টাঙ্গুয়ার হাওরে আসা অতিথি পাখির বড় একটা অংশই হাঁস জাতীয় পাখি৷ এর মধ্যে দেখতে সুন্দর এই পাখিটির নাম লালঝুঁটি-ভুতিহাঁস৷ ইংরেজি নাম রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড৷
দেশি মেটেহাঁস
এটি পাতিহাঁস নামেও পরিচিত৷ ইংরেজি নাম স্পট বিলড ডাক৷ আকারে অনেকটাই গৃহপালিত হাঁসের মতো৷ এটি অবশ্য পরিযায়ী নয়, বাংলাদেশের আবাসিক পাখি৷ তবে বাংলাদেশে সংকটাপন্ন বলে বিবেচিত এবং বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত এই প্রজাতিটি এ হাওরেই বেশি দেখা যায়৷ পাখিটি সাধারণত স্ত্রী-পুরুষের জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়৷
গিরিয়া হাঁস
পাখিটির ইংরেজি নাম গার্গানি৷ বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর অ্যামেরিকা, ওশেনিয়া ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়৷ ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়া এদের প্রধান প্রজননস্থল৷ শীতকালে এসব অঞ্চল থেকে এরা ভারতীয় উপমহাদেশ, অস্ট্রেলেশিয়া ও আফ্রিকায় পরিযান করে৷
মরচে রং ভুতিহাঁস
হাঁস জাতীয় এ পাখিটির ইংরেজি নাম ফেরুজিনাস ডাক৷ এ পখিটিও অনেকটাই গৃহপালিত হাঁসের মতো৷ আকারে ৩২ থেকে ৩৮ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে৷ পাখিটির মাথা, গলা, ঘাড়, বুক ও পিঠ ঘন তামাটে রঙের৷ লেজের নিচের অংশ সাদা৷ পুরুষের চোখ সাদা আর স্ত্রী পাখির চোখ কালচে৷
পিয়াং হাঁস
বাদামি রঙের এ হাঁসটিও শীতে প্রচুর দেখা যায় টাঙ্গুয়ার হাওরে৷ ৩৯ থৈকে ৪৩ সেন্টিমিটার আকারের এ পাখিটি পুরুষের পিঠ কালো-বাদামি রঙের; পেট সাদা রঙের হয়৷ স্ত্রী পাখিটি দেখতে অনেকটা পুরুষ পাখিটির মতো৷ তবে এদের সারা দেহে বাদামি বর্ণের ছোপ ছোপ দেখা যায়৷ এদের ঠোঁট হলুদ সাথে কালো রঙের দাগ থাকে৷
লেঞ্জা হাঁস
উত্তুরে লেঞ্জা হাঁস নামেও পরিচিত৷ এর ইংরেজি নাম নর্দান পিনটেইল৷ বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও পৃথিবীর বহু দেশে এদের দেখা যায়৷ ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর অ্যামেরিকার উত্তরাঞ্চলে এরা প্রজনন করে৷ প্রজাতিটি স্বভাবে পরিযায়ী এবং শীতকালে এর প্রজননস্থলের দক্ষিণে বিষুবীয় অঞ্চলের দিকে চলে আসে৷
পাতারি হাঁস
পাতি তিলি হাঁস নামেও পরিচিত এ পাখিটির ইংরেজি নাম কমন তিল৷ পুরুষ ও স্ত্রী পাখির বর্ণে পার্থক্য রয়েছে৷ পাতি তিলিহাঁস দলবদ্ধভাবে বসবাস করে এবং অপ্রজননকালীন মৌসুমে বিশাল দলে বিচরণ করে৷ বড় সংরক্ষিত জলাশয়ে এদের সহজে দেখা যায়৷ উদ্ভিদ বীজ ও ছোট ছোট জলজ জীব এদের প্রধান খাদ্য৷
পাতি কুট
ইউরেশীয় কুট নামেও পরিচিত এ পাখিটি শীত মৌসুমে প্রচুর দেখা যায় টাঙ্গুয়ার হাওরে৷ প্রধানত এক ধরনের জলচর পাখি এরা৷ পাখিটির শরীর ঘন কালো, চোখ ও কপাল সাদা, পা সাদাটে৷
ধুপনি বক
টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন হাওর ও বিলে এদের দেখা যায়৷ ধূসর বক নামেও পরিচিত এ পাখিটির ইংরেজি নাম গ্রে হেরন৷
বেগুনি বক
লালচে বক নামেও পরিচিত এ পাখিটির ইংরেজি নাম পার্পল হেরন৷ বেগুনি বক আফ্রিকা ছাড়াও, মধ্য এবং দক্ষিণ ইউরোপের পাশাপাশি দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় এই পাখি দেখতে পাওয়া যায়৷ ধূসর বকের মতো অনেকটা দেখতে হলেও বেগুনি বক আকারে কিছুটা ছোট৷ সাধারণত জলাশয়ের আশেপাশে এই পাখির বসবাস৷ মাছ, ব্যাঙ ও জলজ পোকা বেগুনি বকের প্রধান শিকার৷
নেউ পিপি
জল কুকরা নামেও পরিচিত৷ পাখিটির ইংরেজি নাম ফেজান্ট টেইলড জ্যাকানা৷ একটি মেয়ে জল কুকরা এক সঙ্গে কয়েকটি ছেলে কুকরার সঙ্গে জোড়া বেঁধে পদ্মপাতায় ডিম পাড়ে৷ তারপর উড়ে চলে যায়৷ ডিমে তা দেয় ছেলে কুকরারা৷ পোকামাকড়ই এদের প্রধান খাদ্য৷ ৩১ সেন্টিমিটার দৈর্ঘের এ পাখি এই জলাশয়ের স্থায়ী বাসিন্দা৷
পানকৌড়ি
টাঙ্গুয়ার হাওরে শীত মৌসুমে দেখা যায় নানান প্রজাতির পানকৌড়ি৷ শীতের মধ্যেও এরা পানিতে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করে৷ মাঝে মাঝে বিলের পাশে কিংবা ডালপালায় বসে রোদ পোহাতেও দেখা যায়৷
বেগুনি কালেম
কালিম, কায়িম, কায়েম, সুন্দরী পাখি ইত্যাদি নানা নামেই পরিচিত পাখিটি৷ এর ইংরেজি নাম পার্পল সোয়াম্প হেন৷ পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ওশেনিয়া, আফ্রিকা আর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়৷ টাঙ্গুয়ার হাওরের শুকনো জলাশয়ের পাশে এদের দলে দেলে দেখা যায়৷
শিকারী পাখি
শীত মৌসুমে টাঙ্গুয়ার হাওরে দেখা যায় নানা রকম শিকারী পাখি৷ এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বড় চিত্রা ঈগল, সিন্ধু ঈগল, মাছমুরাল, শঙ্খচিল ইত্যাদি৷
মেটে মাথা তিতি
টাঙ্গুয়ার হাওরের জলাভূমির আশপাশের শুকনো ঘাসের মধ্যে মেটে মাথা তিতি বেশি দেখা যায়৷ পাখিটির ইংরেজি নাম গ্রে-হেডেট ল্যাপউইং৷
জল মোরগ
পাখিটি পাতি-পান মুরগি নামেও পরচিতি৷ ইংরেজি নাম কমন মুরহেন৷ টাঙ্গুয়ার হাওরের জলাশয়ের পাশের তৃণভূমিতে বেশি দেখা যায়৷
কালো লেজ জৌরালি
টাঙ্গুয়ার হাওরে শীত মৌসুমে দেখা যায় কালো লেজ জৌরালির দল৷ পাখিটির ইংরেজি নাম ব্ল্যাক টেইলড গোডউইট৷
নীড়ে ফেরা
শীত মৌসুমে খুব ভালো সূর্যাস্ত দেখা যায় টাঙ্গুয়ার হাওরে৷ সূর্যাস্তের সময় পাখিদের দলে দলে নীড়ে ফিরে যাবার দৃশ্যও খুব ভালোভাবে দেখা যায়৷