পরিবেশ-ভাবনা নিয়ে দিল্লিতে বিশ্ব বইমেলা
১২ জানুয়ারি ২০১৮সুদূর কোনও দেশের সঙ্গে সংস্কৃতি বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম হলো বই৷ অক্ষরে অক্ষরে এই সূত্র মেনে রমরমিয়ে চলছে নতুনদিল্লি বিশ্ব বইমেলা৷ এখানে বইয়ের মেলা এবং মেলা-বই নিয়ে হাজির হয়েছে গোটা বিশ্ব৷ প্রতিবারের মতো এবারও বইমেলার যুগ্ম আয়োজক ‘ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট' এবং ‘ইন্ডিয়া ট্রেড প্রমোশন অর্গানাইজেশন'৷ গত শনিবার শুরু হয়েছে৷ ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে বইমেলা৷
বেশিরভাগ প্রকাশক তাঁদের স্টলগুলি ‘পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন'-এর থিমে সাজিয়েছেন৷ পরিবেশ রক্ষায় এটাই এবারের থিম৷ অন্যান্যবারের মতো এবারও কচিকাঁচাদের ভিড় উপচে পড়ছে৷ অবশ্যই ‘হ্যারি পটার' ‘গেম অফ থ্রোনস', ‘এনিড ব্লাইটন' এবং ‘রাস্কিন বন্ড'-এর সামনে লম্বা লাইন৷ এছাড়াও এবারের বইমেলায় কমিক সিরিজ ও কাল্পনিক উপকথা দেদার বিকোচ্ছে৷ সার্কভুক্ত দেশগুলির মধ্যে নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের বই বিশেষ উল্লেখযোগ্য৷ অন্যান্য দেশের মতো প্রতিবেশী এইসব দেশের বইগুলি সেই দেশের সংস্কৃতি, সাহিত্য, পর্যটন, আচার-আচরণ এবং সেখানকার মানুষের ব্যবহারের পরিচয় ও বিচারধারা বহন করছে৷
এবার বইমেলার থিম প্যাভেলিয়ন-৭৷ এখানে ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা-সহ অন্যান্য ভাষায় আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্ব উষ্ণায়ন, জল ও বায়ু দূষণের মতো বিষয়ে বইয়ের সম্ভার৷ ৭-এ, বি এবং সি প্যাভেলিয়নে নেপালের দুটি স্টল রয়েছে৷ ‘হোয়াইট লোটাস' স্টলটিতে নেপালি শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, পর্যটন এবং খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে যুক্ত পাঁচটি প্রকাশকের বই রয়েছে৷ এই বইগুলি জার্মান, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, নেপালি এবং মৈথিলি ভাষায় লেখা হয়েছে৷ শ্রীলঙ্কার স্টলটি ‘শ্রীলঙ্কা বুকস' নামে বানানো হয়েছে৷ এখানে শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষার বই রাখা হয়েছে৷ বেশিরভাগেরই বিষয়বস্তু সেদেশের জঙ্গল, পশু-পাখি, পরিবেশ৷ লোককথার ওপর রচিত ‘রাবণ' নামক বইটি দেদার বিকোচ্ছে৷ বইটিতে রাবণকে একজন রাজা হিসেবে দেখানো হয়েছে৷ এবং হনুমানকে কোনও এক ‘ভালো দেবতা' রূপে তুলে ধরা হয়েছে৷
গত শনিবার বিশ্ব বইমেলার উদ্বোধন করেছেন বিশিষ্ট পরিবেশবিদ সুনীতা নারায়ণ৷ প্রধান অতিথি ছিলেন ইওরোপিয়ান ইউনিয়নে ভারতের রাষ্ট্রদূত টোমাস কোজলোস্কি এবং ‘ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট'-এর চেয়ারম্যান বলদেব ভাই শর্মা৷ উদ্বোধনের পর সুনীতা বলেছেন, ‘‘পশ্চিমী দেশগুলিতে এখন প্রাকৃতিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা চলছে৷ ভারতের মতো দেশে এসেও পশ্চিমের দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠক করছেন৷ প্রচণ্ড শীত, মারাত্মক গ্রীষ্ম এবং অত্যধিক বর্ষার সময়েও জলবায়ু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে৷ ভারতে জলবায়ু পরিবর্তনের আঁচ আসতে আর দেরি নেই৷ ইতিমধ্যেই তার প্রভাব পড়েছে, যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে সমাজের গরিব, কৃষক ও প্রান্তিক মানুষের ওপরে৷ জলবায়ু পরিবর্তন কি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ এর মধ্যেই বাস করতে হচ্ছে আমাদের৷''
বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লির বইমেলায় চোখে পড়ল ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের পক্ষ থেকে দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ ও কর্ণাটকের পরিবেশবিদদের সঙ্গে বইপ্রেমীদের আলাপচারিতা চলছে৷ আবার কিছু দূরে ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর প্রমোশন অফ সিন্ধি ল্যাঙ্গুয়েজ' সিন্ধি ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর অঙ্কন প্রতিযোগিতা চলছে৷ কোথাও আবার পাঞ্জাবী নৃত্যের আয়োজন৷ ‘ভারতীয় সাহিত্য ও ইতিহাসের মিথ ও যথার্থতা' বিষয়ক আলোচনায় অংশ নিতে দেখা গেল যুবা সংস্থার সদস্যদের৷ এরই মাঝে অন্যরকম মনে হলো এক বিমান সংস্থার আয়োজিত ‘সমাজে রচনাত্মক ও কলার ভূমিকা' বিষয়ক মতবিনিময়ের আসরটিকে৷ উর্দু অ্যাকাডেমি পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে আয়োজিত ‘ইন্টারনেট কি বই পড়ার অভ্যাসকে শেষ করছে?' বিষয়ক আলোচনাস্থল বেশ সরগরম ছিল৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি ছাড়াও পাকিস্তান, চীন, ক্যানাডা, মিশর এবং ইংল্যান্ডসহ আরও ৪০টি দেশ এবার অংশ নিয়েছে৷ ‘অথার্স কর্ণার'-এ গিয়ে পাঠকরা যাতে তাঁদের পছন্দের লেখকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও রেখেছেন আয়োজকরা৷ আন্তর্জাতিক স্তরে বিখ্যাত লেখকদের মধ্যে রাসকিন বন্ড, জেরি পিন্টো, মাইকেল ক্রেইটন, পারো আনন্দ, মৃদুলা গর্গ এবং রঞ্জিত লালের মতো লেখকরা দেখা দিচ্ছেন তাঁদের গুনমুগ্ধ পাছকদের৷ কথাও বলছেন৷
অন্যদিকে, আগামী ৩০ জানুয়ারি কলকাতায় শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক বইমেলা। সেখানে বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের সবকটি বড় দেশ অংশ নিতে চলেছে। এবার সর্বোচ্চ ফরাসি পুরস্কার ‘লিজিয়ন অফ অনার' পাচ্ছেন বিশিষ্ট বাঙালি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে সম্মানিত করবেন ফ্রান্সের সংস্কৃতি ও যোগাযোগ মন্ত্রী ফ্রাঙ্কোজ নিসেন।
ভালোর মধ্যে মন্দও আছে৷ বেশকিছু প্রকাশকের অভিযোগ, স্টল বুকিংয়ের খরচ অনেকটাই বাড়ানো হয়েছে৷ কিন্তু, সেই অনুযায়ী বই বিক্রি হচ্ছে কই! সাময়িক প্রকাশনের পক্ষে ললিত কুমার বলছিলেন, ‘‘বইমেলায় তিনফুট বাই তিনফুটের স্টল নিয়েছি৷ এরজন্য দিতে হচ্ছে ৭০,০০০ টাকা৷ একদিকে হিন্দি ভাষার বইয়ের পাঠকে সংখ্যা সীমিত৷ তা-ও দিনদিন পাঠক কমছে৷ ফলে, স্টল বুকিংয়ের খরচ বেড়ে যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে৷ প্রতি বছরই খরচ বাড়ানো হয়৷ তবে এবার অনেকটা বেশি মনে হচ্ছে, কারণ, বইমেলা থেকে আয়ের সম্ভাবনা তো কমেই যাচ্ছে৷ তবে, বড় প্রকাশনা সংস্থার বিষয় আলাদা৷ তাঁরা নিজেদের ব্র্যান্ডের প্রচার এবং জনসংযোগের জন্য ‘সামান্য' ব্যয় করতেই পারেন৷'’