পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতিদের বিরোধ
২৫ জানুয়ারি ২০২৪বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় আদালতে বসে বিচারপতি সৌমেন সেন সম্পর্কে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেছেন, বিচারপতি সেন রাজনৈতিক দিক থেকে পক্ষপাতদুষ্ট। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্য়ায় ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশের বিরুদ্ধে পাল্টা নির্দেশ দিয়েছেন। এটাও নজিরবিহীন ঘটনা।
বিস্ফোরক অভিযোগ
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় হাইকোর্টে নিজের বিচারকক্ষে বলেছেন, ‘‘বড়দিনের ছুটির আগে বিচারপতি অমৃতা সিনহাকে নিজের চেম্বারে ডাকেন বিচারপতি সেন। সেখানে তিনি একজন রাজনৈতিক নেতার মতো কিছু কথা বলেন।’’ এরপর বিচারপতি সেন কী বলেছিলেন, সেটাও জানিয়ে দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘বিচারপতি অমৃতা সিনহাকে বিচারপতি সেন বলেছিলেন, ''অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্য়ায়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আছে। তাকে বিরক্ত করা যাবে না। বিচারপতি সিনহার আদালতে মামলার শুনানির লাইভ স্ট্রিমিং বন্ধ রাখতে হবে। তাছাড়া প্রাথমিকে নিয়োগ সংক্রান্ত দুইটি মামলা খারিজ করতে হবে।’’
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্য়ায় স্পষ্ট করে বলেছেন, এই ঘটনার কথা তিনি বিচারপতি সিনহার কাছেই শুনেছেন। বিচারপতি সিনহা ওই ঘটনার কথা হাইকোর্টের ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকেও জানিয়েছেন।
এখানেই থামেননি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, ‘‘বিচারপতি সেনের রায় বা কার্ষকলাপ রাজনৈতিক স্বার্থে, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের স্বার্থে হচ্ছে। তাহলে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কেন তার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু করবেন না?’’
বিচারপতি সৌমেন সেনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মন্তব্য লিখে রাখার নির্দেশও দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, এই লিপিবদ্ধ পর্যবেক্ষণ যেন ভারতের প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হয়।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘বিচারপতি সেনকে আগেই বদলির নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। তারপর দুই বছর কেটে গেছে। তাঁর বদলি হচ্ছে না কেন?’’
তিনি বলেছেন, ‘‘কেন বদলি হয়নি তা আমি জানি না। আমি দেশের প্রধান বিচারপতিকে এই বিষয়টিও দেখতে অনুরোধ করছি। এই বদলি আটকাতে কার হাত রয়েছে সেটিও দেখার অনুরোধ করবো।’’
বিরোধের সূত্রপাত
এই বিরোধের সূত্রপাত মেডিকেল কলেজে ভর্তিতে বেনিয়মের অভিয়োগ নিয়ে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বুধবার এই বিষয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রাজ্যের পুলিশের উপর আদালতের আস্থা নেই। তারা এতদিনেও শাহজাহানকে গ্রেপ্তার করতে পারে না। তাই তিনি সিবিআইকে এই নির্দেশ দিচ্ছেন।
বুধবার বিকেলেই এই রায়ের উপর স্থগিতাদেশ জারি করেন বিচারপতি সেনের নেতৃত্বে ডিভিশন বেঞ্চ।
বৃহস্পতিবার মামলাটি আবার বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চে ওঠে। সরকারি আইনজীবী তাকে বলেন, বিচারপতি সেনের ডিভিশন বেঞ্চ স্থগিতাদেশ দিয়েছে। তিনি রায়ের লিখিত কপি বা লাইভ স্ট্রিমিং দেখতে চান, তা তখনই তাকে দিতে পারেননি আইনজীবী।
তখন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্য়ায় নির্দেশ দেন, অবিলম্বে সিবিআইকে এফআইআর করতে হবে। এজন্য তারা প্রয়োজনীয় নথিপত্র যেন আদালত থেকে নিয়ে যান।
এরপর রাজ্যের তরফে আবার বিচারপতি সেনের বেঞ্চে আবেদন জানানো হয়। বিচারপতি সেনের বেঞ্চ সিবিআই তদন্তের উপর, সিবিআইয়ের এফআইআরের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে। তারা জানান, সিবিআইকে সব নথি আবার আদালতে ফেরত দিতে হবে।
এরপরই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় আদালতে ওই মন্তব্য করেন। তিনি জানিয়ে দেন, বিচারপতি সেনের বেঞ্চ যে নির্দেশ দিয়েছেন তা অবৈধ। সিবিআইকে এফআইআর জমা দিতে হবে ও তার নির্দেশ মেনে কাজ করতে হবে। দুই মাসের মধ্য়ে তারা এই তদন্তের কাজ শেষ করবে।
রাজ্য সরকারের আইনজীবী আবার বিচারপতি সেনের বেঞ্চে গিয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বলা কথাগুলি জানান। বিচারপতি সেন নির্দেশ দেন, বিষয়টি প্রধান বিচারপতিকে জানাতে।
প্রতিক্রিয়া
তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী এবং রাজ্য়ের স্বাস্থ্যপ্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেছেন, ''বিচারপতিদের কতটা দূর যাওয়া দরকার তা নিশ্চয়ই বিচারপতিরা বুঝবেন। কিন্তু একজন বিচারপতি যদি অন্য একজন বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলেন, তাহলে আমার মনে হয়, তিনি নিজেকেই অপমান করছেন।''
চন্দ্রিমা বলেছেন, ‘‘এই প্রশ্নও ওঠে, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্য়ায় কি কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছেন? উনি বারবার সিবিআইয়ের কথা বলেন। তাহলে কি উনি কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ভরসা করছেন?’’
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর মতে, ‘‘এসব প্রশ্ন তো ওঠা উচিত নয়। বিচারপতি নিরপেক্ষ থাকবেন। বিচারপতি তার সীমার কথাটা বুঝবেন।’’
এ প্রসঙ্গে বিজেপি-র মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছে। শাসক দল বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করছে। সরাসরি রাজনীতির ময়দানে নামার কথা বলছে। বিচারপতিরা তীর্যক মন্তব্য করছেন। আমরা চাই সুস্থ পরিবেশ তৈরি হোক। যেখানে বিচারবিভগীয় অ্যাক্টিভিজমের কোনো দরকার হবে না।’’
তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। তাই সবকিছুর জন্য আদালতে যেতে হয়। সরকারের সব সিদ্ধান্ত কোর্টে চ্যালে়ঞ্জ হচ্ছে। সরকার বিচারপতিদের ভয়. দেখানোর চেষ্টা করছে। সরকারের উদ্দেশ্য যে কোনো মূল্য়ে তদন্ত বন্ধ করা। বিচারপতিদের সংঘাত কাম্য নয়, বিচারব্যবস্থা যারা দেখেন, তারা বিষয়টির সমাধান করবেন।’’
প্রবীণ সাংবাদিক আশিস গুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘আসলে পুরো সমাজ দুর্নীতিগ্রস্ত। ভারতে তার প্রভাব সব জায়গায় পড়ে। আগে বিচারব্যবস্থার দিকে কেউ আঙুল তুলতো না। রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও চাপের মুখে তা প্রকাশ্যে চলে আসছে। বিচারপতিরা নিজেরাই অভিয়োগ করছেন। মারাত্মক অভিযোগ। আগে রাজনীতির মানুষরা এত বেশি আদালতে যেতো না। এখন যাচ্ছে। সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। সেজন্য সম্ভবত এই বিষয়গুলি প্রকাশ্যে আসছে।’’
জিএইচ/এসিবি (আনন্দবাজার, টিবি৯, জি নিউজ)