1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নড়িয়ায় ভাঙন, হাজারো মানুষের কান্না

১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলায় পদ্মার ভাঙনে এরই মধ্যে পাঁচ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে৷ নদী গর্ভে চলে গেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি৷বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষার পানি না কমা পর্যন্ত ভাঙন থামবে না৷

https://p.dw.com/p/34ol7
ছবি: bdnews24.com

আলমগীর হোসেন৷ নড়িয়ার কেদারপুর ইউনিয়নের চর নড়িয়া গ্রামের একজন সম্পন্ন কৃষক৷ তিনি, তাঁর বাবা-মা, তাঁর তিন ভাই এবং তাঁদের স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ভালোভাবেই জীবন কাটাচ্ছিলেন৷ কিন্তু পদ্মার ভাঙনে তাঁদের পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে৷ একই বাড়িতে চারটি পাকা ঘরে তাঁরা বসবাস করতেন৷ কিন্তু এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন৷ দুই ভাই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভাড়া বাসায় উঠেছেন৷ আর দুই ভাই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় পেয়েছেন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে৷ বাবা-মা আশ্রয় নিয়েছেন আরেক বাড়িতে৷

আলমগীর হোসেন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে দুপুরের দিকে আমাদের পুরো বাড়ি চোখের সামনে পদ্মার গর্ভে চলে যায়৷ আমাদের কোনো সম্পদই আমরা সরাতে পারিনি৷ আমার মনে হচ্ছিল বাড়িটি দেবে যাচ্ছে৷ আমরা সবাই বাড়ির বাইরে দৌড়ে বের হই৷ বড় সড়কে চলে যাই৷ আর ততক্ষণে নদীর ভাঙনে আমাদের বাড়ি হারিয়ে যায়৷’’

আমাদের কোনো সম্পদই আমরা সরাতে পারিনি: আলমগীর হোসেন

তিনি বলেন,‘‘আমাদের বাড়িতে মোট চারটি টিনশেড পাকা ঘর ছিল, যা নদীতে চলে গেছে৷ ঘরে যা ছিল তা-ও গেছে৷ বাড়ির কাছে ১৫ বিঘা ফসলি জমি ছিল, পুকুর ছিল৷ কিছুই এখন নেই৷ আমরা চার ভাই, আমাদের স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা সবাই এখন নিঃস্ব্, পথের ফকির হয়ে গেলাম৷’’

এই করুণ গল্প শুধু আলমগীর হোসেন ও তাঁর পরিবারের নয়৷ নড়িয়া পৌরসভা, বাঁশতলা , সাধুর বাজার, ওয়াপদা, মুলফতগঞ্জ, কেদারপুরসহ আরো অনেক এলাকার বহু মানুষের৷ পদ্মার ভাঙনে একের পর এক গ্রাম বিলীন হচ্ছে৷ বিলীন হচ্ছে বাজার, মন্দির, মসজিদ৷ আর বাড়ছে গৃহহীন, সব হারানো মানুষের সংখ্যা৷

আলমগীর হোসেন জানান,‘‘শুধু আমাদের বাড়ি নয়, পুরো চড় নড়িয়া গ্রামটিই বিলীন হয়ে গেছে৷ এই গ্রামে তিনশ' পরিবার, এক হাজারের বেশি ঘর, তাঁদের ফসলি জমি, সব নদী কেড়ে নিয়েছে৷ সবাইকে নিঃস্ব করে দিয়েছে৷ কেউ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন, কেউ ঢাকাসহ দেশের অন্য এলাকায় আত্মীয় স্বজনের কাছে চলে গেছেন৷’’

নড়িয়া এখন এক ভাঙন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে: মনির হোসেন সাজিদ

স্থানীয় সাংবাদিক মনির হোসেন সাজিদ জানান,‘‘পদ্মা তীরের নড়িয়া এখন এক ভাঙন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে৷ অনেকেই তাঁদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিচ্ছেন৷ ভাঙন অব্যাহত থাকায় নতুন করে প্রতিদিনই লোকজন নিঃস্ব হচ্ছেন৷’’

তিনি জানান, ‘‘নড়িয়া পৌর এলাকাসহ বাঁশতলা, সাধুর বাজার, ওয়াপদা, মুলফতগঞ্জ বাজার,কেদারপুর ও চর নড়িয়াসহ আরো অনেক এলাকার বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে চলে গেছে৷ মুলফতগঞ্জ একটি প্রাচীন বাজার৷ এই বাজারসহ তিনটি বাজার বিলীন হয়ে গেছে৷ তিনশ'রও বেশি দোকানপাট নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে৷ এছাড়া একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, দু'টি সরকাররি বিদ্যালয় ভবন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তিন তলা ভবন, গাড়ির গ্যারেজ, মসজিদ, মন্দির, ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তা ও ফসলি জমি নদী গর্ভে চলে গেছে৷ পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ ভাঙনের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন৷’’

তিনি আরো জানান,‘‘নদী গর্ভে ১৬টি বহুতল ভবনসহ ৮০টি পাকা ভবন এবং আরো অনেক বাড়ি-ঘর বিলীন হয়ে গেছে৷ ফসলি জমি গেছে সাতশ' একর৷’’

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, জুলাই থেকে যে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে, তাতে প্রায় আড়াই বর্গ কিলোমিটার এলাকা নদী গর্ভে চলে গেছে৷ শরিয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘আমরা বালুভর্তি আড়াইশ' কেজি ওজনের জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙনের তীব্রতা কমানোর চেষ্টা করছি৷ এ পর্যন্ত আমরা এক লাখ ২৮ হাজার ব্যাগ ডাম্পিং করেছি৷’’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘‘বর্ষাকালে ভাঙন রোধে আর কোনো ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই৷ বিকল্প যে ব্যবস্থা আছে, তা শুষ্ক মৌসুমের জন্য৷ তখন হার্ড রক অথবা ব্লক ফেলে ভাঙন রোধ করতে হয়৷’’

এ পর্যন্ত আমরা এক লাখ ২৮ হাজার ব্যাগ ডাম্পিং করেছি: শফিকুল ইসলাম

তিনি বলেন,‘‘নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙনের নানা কারণ থাকতে পারে৷ কিন্তু আমাদের বিবেচনায় প্রধান কারণ হলো নদীর মাঝখানে একটি চর জেগেছে৷ ফলে নদীর মূল স্রোতে দক্ষিণ প্রান্ত থেকে উত্তর প্রান্তে, অর্থাৎ নড়িয়ার দিকে সরে এসেছে৷ ফলে নড়িয়া ভাঙছে তীব্রস্রোতে৷ এছাড়া আরো অনেক কারণ থাকতে পারে৷ নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে৷ এগুলো অ্যাসেস না করে বলা যায় না৷ এবার সর্বোচ্চ সাড়ে চারশ' মিটার থেকে সর্বনিম্ন ৭০ মিটার পর্যন্ত ভেঙেছে৷ এর ব্যাপ্তি আড়াই বর্গ কি. মি.৷’’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, নড়িয়ায় সাত বছরে ভেঙেছে ১৩ দশমিক ২৬ বর্গ কি.মি এলাকা৷ ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ভেঙেছে ৪ বর্গ কি.মি. এলাকা৷ আর জুলাই থেকে যে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে, তাতে নদীগর্ভে গেছে প্রায় ৩ বর্গ কি. মি. এলাকা৷ শফিকুল ইসলাম জানান,‘‘এই ভাঙন সেপ্টেম্বর মাস জুড়েই চলতে থাকবে৷ এরপর বর্ষার পানি যখন কমতে থাকবে, তখন ভাঙনের তীব্রতা কমবে বলে আশা করি৷’’

ব্যাংকগুলোকে আগামী পাঁচ মাস ঋণের কিস্তি আদায় না করতে বলা হয়েছে: সানজিদা ইয়াসমিন

নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন ডয়চে ভেলেকে জানান,‘‘আমরা ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে তিন হাজার পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছি৷ সাড়ে তিনশ' পরিবারকে দুই বান্ডিল করে ঢেউটিন দেয়া হয়েছে৷ ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি খাস জমিতে পুনর্বাসন করা হবে৷ গুচ্ছ গ্রাম এবং আশ্রয়ণ প্রকল্পেও তাঁরা ঘর-বাড়ি পাবেন৷ আর ব্যাংকগুলোকে আগামী পাঁচ মাস ঋণের কিস্তি আদায় না করতে বলা হয়েছে৷ যাঁরা নতুন করে ঋণ নেবেন, তাঁদের আমরা সহায়তা করব৷’’

পদ্মা তীরবর্তী নড়িয়ায় অতীতে নদী ভাঙন হয়েছে৷ তবে অন্য এলাকায়৷ নড়িয়ার সুরেশ্বর দরবার শরিফ রক্ষার জন্য ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯০০ মিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয় বলে জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ড৷

নদী ভাঙন রোধে ২০১২-১৩ অর্থবছরে জলবাযু ট্রাস্ট তহবিলের অর্থে নড়িয়ার চন্ডপুর, সাধুর বাজার ও পাঁচগাও এলকায় ১২ কোটি বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়৷

নির্বাহী প্রকৌশলী জানান,‘‘পুরো নড়িয়া এলাকায় নদী ভাঙন রোধে এক হাজার ৯৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়েছে৷ শুষ্ক মৌসুমে এর কাজ শুরু হবে৷’’

২০১৪ সালের ছবিঘরটি দেখুন...