বিশ্বস্বাস্থ্য
৩ মার্চ ২০১২হেপাটাইটিস সি রোগটি সম্পর্কে মানুষের সুস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই৷ হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলির মধ্যে সি ভাইরাস সবচেয়ে মারাত্মক বলে মনে করা হয়৷ এই অসুখটিকে চিকিত্সা বিজ্ঞানে নীরব ঘাতক বলেও অভিহিত করা হয়৷ তাই এই ভাইরাসের মোকাবেলায় মাথা ঘামাচ্ছেন এখন গবেষকরা৷
বাংলাদেশেও বহু মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত
বাংলাদেশে আনুমানিক ৩ থেকে ৬ ভাগ মানুষ হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের বাহক৷ বিশেষ করে পেশাদার রক্তদাতাদের মধ্যে অনেকেই এই ভাইরাস বহন করেন৷ হেপাটাইটিস সি'র ভাইরাস সাধারণত দূষিত রক্তের মাধ্যমে ছড়ায়৷ তাই শেভিং রেজার, ব্লেড, টুথব্রাশ ও ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ইত্যাদি সাবধানে ব্যবহার করা উচিত৷ একই সুচ দিয়ে মাদক সেবন করলেও বিস্তৃত হতে পারে হেপাটাইটাইস সি ভাইরাস৷
সাধারণত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রথম কয়েক বছর সুস্পষ্ট কিছু বোঝা যায় না৷ শরীর ম্যাজম্যাজ করা, বমি বমি ভাব, চোখ জ্বালা করা, পেশিতে যন্ত্রণা, এই সব রোগের প্রাথমিক লক্ষণ বলে মনে করা হয়৷ রোগীদের খাওয়ায় রুচি কম থাকে, লেগে থাকে পেটের অসুখ৷ এই সব উপসর্গ থেকে লিভার সিরোসিস, লিভার অকার্যকর হয়ে যাওয়া কিংবা লিভার ক্যান্সারের মত কঠিন রোগও দেখা দিতে পারে৷
এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসকে প্রতিরোধ করার মত টিকা বের হয়নি৷ এক ধরনের প্রোটিন বা ইন্টারফেরন দিয়ে থেরাপি দেয়া হয় রোগীদের৷ এর মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধক শক্তি বৃদ্ধি পায়৷ সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি নতুন ওষুধ ছাড়পত্র পেয়েছে, যেটি আরো কার্যকর বলে মনে করা হয়৷
নতুন থেরাপি আশা জাগাচ্ছে
পদার্থটির নাম টেলাপ্রেভির৷ এতদিন পর্যন্ত ইন্টারফেরনের সঙ্গে রাইবাভাইরিন নামে এক ধরনের ভাইরাস দমনকারী ওষুধ যুক্ত করে থেরাপি দেয়া হত৷ নতুন ওষুধ টেলাপ্রেভির প্রচলিত থেরাপির বিকল্প হবে না, বরং পরিপূরক হবে৷ তার মানে রোগটির বিরুদ্ধে ত্রিমুখী আক্রমণ করা হবে৷ কয়েকটি সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে হানোফার শহরের মেডিকেল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হাইনার ভেডেমায়ার বলেন, ‘‘প্রচলিত থেরাপিতে ৫০ শতাংশ রোগী আরোগ্য লাভ করেন৷ কিন্তু নতুন ওষুধকে পরিপূরক হিসাবে নেয়ার পর ৭৫ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়েছেন৷ তার মানে প্রায় ৩০ শতাংশের মত বেশি রোগী উপকৃত হয়েছেন নতুন থেরাপিতে৷ বলা যায়, প্রতি পাঁচ জনে চার জন থেরাপির শেষে সুস্থ হতে পারেন৷ অন্য আরেক বিশ্লেষণে ৮০ শতাংশ রোগীর আরোগ্য লাভের কথা বলা হয়েছে৷''
জটিল ও ব্যয়বহুল
প্রচলিত পদ্ধতির ইন্টারফেরন-থেরাপিটা এমনিতেই বেশ জটিল৷ প্রতি সপ্তাহে একবার ইঞ্জেকশন নিতে হয়৷ তার ওপর ইন্টারফেরনকে শক্তিশালী করার জন্য আরেক ওষুধ ট্যাবলেটের আকারে দিনে দুবার খেতে হয়৷ এই ভাবে ৪৮ সপ্তাহ বা এক বছরের মত চালাতে হয় থেরাপি৷ এর সঙ্গে টেলাপ্রেভির যুক্ত হলে থেরাপির সময়টা কমে ২৪ সপ্তাহে দাঁড়াবে৷ যে সব রোগী প্রচলিত পদ্ধতিতে ভাল হননি, তাদের মধ্যেও ৩০ শতাংশ নতুন থেরাপিতে ভাল হয়েছেন৷ তবে এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে৷
প্রফেসর ভেডেমায়ার জানান, ‘‘টেলাপ্রেভিরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ত্বকের ক্ষতি হতে পারে৷ শরীরের অর্ধেকই আক্রান্ত হতে পারে৷ চামড়া লাল হওয়া থেকে শুরু করে ফোসকা পড়া এসব কিছুই লক্ষ্য করা যায়৷ অনেক সময় দেখা যায় ডায়রিয়া৷ ১০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এটা হতে পারে৷ তা হলে এই চিকিত্সা বন্ধ করে দেয়া উচিত৷''
অন্যান্য ওষুধের সঙ্গেও এর মিথস্ক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যেমন বাতের ওষুধের সঙ্গে এটি ব্যবহার করলে৷ প্রফেসর ভেডেমায়ারের ভাষায়, ‘‘এই থেরাপির জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন৷ থেরাপিটা বেশ জটিল, শুধু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার জন্যই নয়৷ এই থেরাপি সঠিক ভাবে না চালালে কিংবা ওষুধ নিয়মিত না খেলে এক ধরনের প্রতিরোধক সৃষ্টি হতে পারে৷ যা রোগীদের জন্য বেশ বিপজ্জনক৷''
নতুন থেরাপিতে নিয়মটাও বেশ কঠোর৷ ৮ ঘন্টা পর পর ক্যাপসুল খেতে হয়৷ এজন্য রোগীকে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল হতে হয়৷ এই ওষুধকে খুব সস্তাও বলা যায় না৷ সপ্তাহে খরচ পড়ে এক হাজার ডলার৷ ছয় মাসের খরচ ১৭ হাজার ইউরোর মত৷ বলা যায়, হেপাটাইটিস সি দমন করার জন্য নতুন থেরাপি বের করা গেলেও দামটা আকাশচুম্বী৷ তাই এই রোগে আক্রান্ত সব রোগীর চিকিত্সা এই থেরাপির মাধ্যমে দেয়া এখন পর্যন্ত সম্ভব নয়৷
প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক