সংখ্যালঘুরাই হয়রানির শিকার
৫ জানুয়ারি ২০১৭৩০শে অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু পল্লি এবং মন্দিরে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০৫ জন গ্রেপ্তার হলেও, তাদের অধিকাংশই ছাড়া পেয়ে গেছে৷ অথচ রসরাজ ফেসবুকে তার মোবাইল ফোন থেকে কোনো পোস্ট দেয়নি – এ কথা প্রমাণ হওয়ার পরও তাকে জামিন দেয়া হচ্ছে না৷ দু'মাসেরও বেশি সময় ধরে সে কারাগারে আটক আছে৷ তার বিরুদ্ধে পুলিশ তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দিয়েছে, যা কিনা জামিন অযোগ্য৷
গত ৩রা জানুয়ারি রসরাজের জামিন শুনানি ছিল৷ কিন্তু আদালত পুলিশ প্রতিবেদন না পাওয়ায় তাকে জামিন দেয়নি৷ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘‘ফেসবুক আইডি-টি রসরাসের৷ তাই তাকেই দায় নিতে হবে৷'’
একইভাবে ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে কক্সবাজারের রামু বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার ঘটনায় ফেসবুক পোস্টের কথা বলে উত্তম বড়ুয়া নামে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক যুবককে আটক করা হয়৷ পরে প্রমাণিত হয় যে সে কোনো পোস্ট দেননি৷ উত্তম বড়ুয়া পরে জামিন পেলেও সে এখন কোথায় আছে, তা কেউ জানে না৷ এমনকি তার পরিবারের সদস্যরাও না৷ অথচ হামলার জন্য যাদের আটক করা হয়েছিল তারা সবাই জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায়ই আছে৷
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ জানায়, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাসেই প্রায় তিনগুণ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে৷ জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ – এই তিন মাসে ৮২৫০টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে৷ এর মধ্যে হত্যা, অপহরণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, গণধর্ষণ, জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছেদের ঘটনা রয়েছে৷
তারা জানায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ২৬১টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ যাতে কিনা ১৫৬২টি প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ কিন্তু ২০১৬ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে সংখ্যালঘুদের ওপর কমপক্ষে ৭৩২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় তিনগুণ৷ এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৫৬৬টি, যা আগের এক বছরের তুলনায় ছয়গুণেরও বেশি৷ এ সময়ে ১০ জন নিহত, ৩৬৬ জন আহত এবং ১০ জন অপহরণের শিকার হন৷ জোরপূর্বক ধর্মান্তরের অভিযোগ আছে দু'টি৷ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন আটজন৷ এছাড়া জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, দখল ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৬৫৫টি৷ উচ্ছেদের হুমকি দেয়া হয়েছে ২২টি পরিবারকে৷
২০০১ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশের বরিশাল, বাগেরহাট, পাবনা ও নড়াইলসহ বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ এরপর থেকে একযোগে বিভিন্ন সংখ্যালঘু নির্যাতন কমে আসলেও তা থামেনি৷ ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর বড় ধরনের হামলা হয়৷ সর্বশেষ গত ৩০শে অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের শতাধিক বাড়ি-ঘরে হামলা-ভাঙচুর এবং লুটপাট করা হয়৷ এ সময় অন্তত ১০টি মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়৷ বেধড়ক পেটানো হয় হিন্দু পল্লির নারী-পুরুষকে৷
এরপর সারাদেশে আরো অন্তত পাঁচটি মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও, তা নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি৷
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৯৯০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় মামলারই সুযোগ দেয়া হয়নি৷ শাহাবুদ্দিন কমিশন তদন্ত করে কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছিল ঠিকই, তবে এখনও সে মামলার বিচার হয়নি৷ আমার জানা মতে, মাত্র তিনটি ঘটনার বিচার হয়েছে – গোপলা মুহুরী হত্যা, জ্ঞানজ্যোতি মহাথেরো হত্যা এবং পূর্ণিমার ওপর নির্যাতনের ঘটনা৷''
তিনি বলেন, ‘‘নাসিরনগরের রসরাজ আর রামুর উত্তম বড়ুয়া আটকের ঘটনাই প্রমাণ করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর বিচারের নমুনা৷ যারা নির্যাতনের শিকার তাদেরই আবার কারাগারে পাঠানো হয়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের সঙ্গে যখন ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকেন, তখন বিচার পওয়ার প্রশ্নই ওঠে না৷''
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান এ বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের বিচার হয় না – এটা সত্য৷ এর পেছনে আছে রাজনৈতিক কারণ৷ রাষ্ট্র বা সরকার তাদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না৷''
তাঁর কথায়, ‘‘সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলে, সেক্ষেত্রে পুলিশ বেশ তৎপর থাকে৷ এই অবস্থার সহসা পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না৷''
রানা দাসগুপ্ত মনে করেন, ‘‘প্রচলিত আইনে সংখ্যালঘুরা বিচার পাবে না৷ এ জন্য আলাদা আইন ও ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে৷''
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা কখনোই হামলা, নির্যাতনের বিচার পায় না, বিচার চাইলে উল্টে তাদেরই হয়রানির শিকার হতে হয়৷ প্রিয় পাঠক, এই বিচারহীনতা কি আপনি সমর্থন করেন?