ভারতের আরেক নির্ভয়া
১৭ মে ২০১৭তাহলে, শাসন কিংবা শাস্তির ভয়? ওসব আছে আইনের বইয়ের পাতায়৷ দেশের নারী সুরক্ষা আজও প্রশ্নচিহ্নের মুখে৷
বছর পাঁচেক আগে দিল্লিতে চলন্ত বাসে এক প্যারামেডিকেল ছাত্রীকে গণধর্ষণের পরে অকথ্য অত্যাচার করে মৃতপ্রায় নগ্ন অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে পালিয়ে যায় পাষণ্ডরা৷ বাসের চাকায় পিষে মারার চেষ্টাও করেছিল তারা৷ সে যাত্রায় আর ঘরে ফেরা হয়নি মেয়েটির৷ গোটা ভারতের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল মেয়েটির ওপর পাশবিক (পশুরাও বোধহয় এমন অত্যাচার করে না) অত্যাচার৷ গণআন্দোলন জন্ম নিয়েছিল দিল্লির বুকে৷ ২৩ বছরের সেই মেয়ে জ্যোতি সিংয়ের নাম রাখা হয়েছিল নির্ভয়া৷ এই তো ক’দিন আগেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত ৪ নরাধমকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছে৷ কিন্তু, তাতেও এতটুকু পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি৷ আর তার ঠিক তিন দিনের মাথাতেই ফের আরও এক নির্ভয়ার খোঁজ পাওয়া গেল৷ দিল্লির নির্ভয়ার মতোই ধর্ষণের পর হরিয়ানার এই নির্ভয়ার যৌনাঙ্গও ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হলো৷ থেঁতলে দেওয়া হলো তাঁর মুখ৷ ৯ মে নৃশংস এই ঘটনাটি ঘটেছে হরিয়ানার রোহতাক জেলায়৷ ঘটনার দিন হেঁটে অফিস যাচ্ছিলেন ওই তরুণী৷ মাঝ রাস্তা থেকেই তাঁকে অপহরণ করে সাত জন৷ রোহতাকের এক ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হয় তাঁকে৷ এখানেই শেষ নয়৷ যন্ত্রণায় কাতরানো ওই তরুণীর যৌনাঙ্গে ধারালো অস্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ তাঁর পরিচয় যাতে কেউ জানতে না পারে, তার জন্য একটি গাড়ি তাঁর মাথার উপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয়৷ নির্যাতিতার মুখ ও শরীরের কিছু অংশ রাস্তার কুকুরেও কামড়েছে৷ হিংস্রতা এমনও হয়!
বিবাহবিচ্ছেদের পর বাবা মা'র সঙ্গেই থাকতেন বছর ২৩-এর ওই যুবতী৷ গত মঙ্গলবার সোনিপত থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়৷ মেয়ে রাতে বাড়ি না ফেরায় তরুণীর পরিবার পরের দিন পুলিশে নিখোঁজ ডায়েরি করেন৷ সেই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে তার তিন দিন পর, ১২ মে রোহতাকের ওই ফাঁকা এলাকা থেকে ওই তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ৷ কিন্তু তাঁর মাথা এতটাই থ্যাঁতলানো ছিল যে তাঁকে চিনতে পারেনি পুলিশ৷ পরিবারকে খবর দিলে তাঁরাই থানায় গিয়ে তাঁকে শনাক্ত করেন৷
পুরোনো কথা মনে পড়ছে সবার৷ সেই ২০১২-র ১২ ডিসেম্বর, সঙ্গীর সঙ্গে সিনেমা দেখে বাসে বাড়ি ফিরছিলেন ফিজিওথেরাপির ছাত্রী জ্যোতি সিংহ৷ সেই বাসে ছিল আরও ছয় জন৷ বাস চলতে শুরু করলে জ্যোতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যেরা৷ সঙ্গীর সামনেই জ্যোতিকে একে একে ধর্ষণ করে ছয় জন৷ ধর্ষণের পর নৃশংস অত্যাচার করা হয় তাঁর উপর৷ এই ঘটনা সামনে আসার পর বিচার চেয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়৷ পরে ছয় অপরাধীকেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ এক জন নাবালক হওয়ায় জুভেনাইল কোর্টে তিন বছরের সাজা মেলে তার৷ ২০১৫ সালে সে ছাড়া পেয়ে যায়৷ মামলা চলাকালীনই ২০১৩-র মার্চে তিহার জেলে আত্মহত্যা করে আর এক অভিযুক্ত৷ আর বাকি চার অপরাধীর ফাঁসির সাজা হয়৷ রাজধানীর ওই ঘটনার নৃশংসতার স্মৃতি আজও তাজা৷ অপরাধীদের এই শাস্তিতে সমাজে অপরাধ আদৌ কমবে কি না তা নিয়ে সংশয় ছিলই, হরিয়ানার এই ঘটনায় সেই প্রশ্ন আরও জোরালো হলো৷
সমগ্র বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখেন বাংলার বিশিষ্ট কবি ও রাজনীতিক৷ তাঁর কথায়, ‘‘একটা দেশ বা রাষ্ট্রে যখন ধন-বৈষম্য তৈরি হয়, তখন সমাজ, আইন-কানুনকে আর কেউ মানতে চায় না৷ মানুষের মনে হয়, আমি যা চাই তা কেড়ে নেবো৷ স্বার্থপরতা প্রকট আকার ধারণ করে৷ সামজের প্রতি ভালোবাসা বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না৷ তাই ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধও বাড়ছে৷ অমানবিক নৃশংসতা বাড়ছে৷ এর প্রধান কারণই হলো, এক শ্রেণির হাতে প্রচুর অর্থ এবং উল্টোদিকে গরিব ও বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া৷ দেশ, সমাজ এবং অপরকে সম্মান করার মানসিকতার ভিত আজকে নড়বড়ে৷ ধর্ষণকারীদের প্রতি সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে৷ সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে৷ সর্বোপরি পুঁজিপতি অর্থ ব্যবস্থার পরিবর্তন করতেই হবে৷’’
মেয়েটির পরিবারের হাল কেমন হতে পারে?
ছোট্ট এক ঘরের ফ্ল্যাটের মেঝেতে শুয়ে রয়েছেন মা৷ দিল্লি থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরে৷ মেয়েকে গণধর্ষণ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে জানার পরে তিনি আর হাঁটাচলা করতে পারছেন না৷ শুধু গণধর্ষণের যন্ত্রণা নয়, মেয়েটিকে যাতে পরে চেনা না যায়, তার জন্য অভিযুক্তরা তাঁর মুখ আর মাথাও ইট মেরে থেঁতলে দিয়েছিল৷ মা এই সব জেনেছেন৷ জানতে পেরেছেন মাদক বা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ধর্ষণের পরে নির্যাতনকারীরা গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিল মেয়েটির দেহের উপর দিয়ে৷ জেনেছেন, পড়ে থাকা দেহ থেকে মুখ আর নিম্নাংশ খুবলে খেয়েছে কুকুরে৷ ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পড়ে জেনেছেন, মেয়ের খুলিটা টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল৷ তাঁর যৌনাঙ্গের গভীর ক্ষত থেকে মনে হয়েছে কোনও ধারালো বস্তু ঢোকানো হয়েছিল৷ নিজের মেয়ের সম্পর্কে এই সব ভয়ংকর তথ্য শুনেছেন তাঁর মা৷
মা বলছেন, ‘‘নির্ভয়া-কাণ্ডে দোষীরা সাজা পাওয়ার পরে সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে গ্রামের সবাই আলোচনা করেছি৷ মনে হয়েছিল, এবার হয়তো এমন অপরাধ করার আগে দুস্কৃতীরা দু'বার ভাববে৷ এখন বুঝছি, মেয়েদের নিরাপত্তা নেই৷ সাজা পেয়েও লোকজনের কোনও ভয় নেই৷’’ মেয়ের দিনমজুর বাবা বলেছেন, ‘‘দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছি মেয়েকে৷ টাকার অভাবে আর পড়াতে পারিনি৷ একটি ওষুধ সংস্থায় কাজ পেয়েছিল সে৷ মাসে চার হাজার টাকা মাইনে পেত৷ এই বয়সে যেভাবে ও সাহায্য করছিল, তাতে গর্ব হতো৷’’
এদিকে, অভিযুক্ত মোট আটজনের মধ্যে দু'জনকে গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর জানিয়েছেন, ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্টে এই মামলার শুনানি হবে৷ পুলিশের দাবি, সুমিত নামে মুখ্য অভিযুক্ত মেয়েটিকে বিয়ে করতে চেয়েছিল৷ মেয়েটি আপত্তি করায় প্রতিশোধ নিতে চেয়ে সে এই ঘটনা ঘটিয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়ে অবশ্য রাজনীতিও শুরু হয়ে গেছে ভারতে৷
শিক্ষিকা রুমা ব্যানার্জি বলছেন, ‘‘আমি এক মেয়ের মা, সামাজিক এই অবক্ষয় দেখে ভীষণ ভয় পাই৷ মেয়ে কলেজে গেলে বাড়িতে মন বসে না৷ আমার মতোই কোটি কোটি মা দিনরাত দুশ্চিন্তায় থাকেন৷ ধর্ষণকারীরা কেউ মানুষ নয়৷ শয়তান৷ হয় আইন সংশোধন করা হোক, তা না হলে একদিন এমন আসবে যখন মেয়েরা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হবে৷’’
পেটের টানে মেয়েকে বাড়িতে রেখেই কাজে বেরিয়ে যেতেন মা৷ দিন মজুরের কাজ৷ অনেক সময় কয়েক দিনের জন্য রাজ্যের বাইরেও যেতে হতো তাঁকে৷ বাড়িতে অবশ্য স্বামী রয়েছে, তাই দূরে গিয়েও খানিক নিশ্চিন্ত থাকতেন৷ কিন্তু স্বপ্নেও ভাবেননি যে রক্ষার দায়িত্বে যাঁকে রাখা হয়েছে, সেই স্বামীই হবে তাঁর মেয়ের ধর্ষক৷ দীর্ঘ দিন ধরে ১০ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠল তারই সৎ বাবার বিরুদ্ধে৷ এখন সে অন্তঃসত্ত্বা৷ গুরুতর অসুস্থ হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷ ঘটনাটি ঘটেছে হরিয়ানার রোহতাকে৷ পুলিশ জানিয়েছে, তার মা কর্মসূত্রে মাঝে মধ্যেই বাইরে থাকতেন৷ আর সেই সুযোগেই নাবালিকার উপরে লাগাতার ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন চালিয়ে গেছে সৎ বাবা৷ সম্প্রতি ওই নাবালিকা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যান মা৷ তখনই ঘটনাটি সামনে আসে৷ চিকিৎসকেরা তাঁকে জানান যে, ওই নাবালিকা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা৷ পরে নাবালিকাকে জি়জ্ঞাসা করলে সে-ও মুখ খোলে৷ সে জানায়, সুযোগ পেলেই ওই ব্যক্তি তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ত৷ উপরন্তু ভয়ও দেখাতো৷ তাই সে এত দিন কাউকে বিষয়টি জানানোর সাহস পায়নি৷
সেই রোহতাক, যেখানে শুক্রবার রাতে গণধর্ষণের পর নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে এক তরুণীকে৷
বছর বাইশের ওই নির্যাতিতা আদতে সিকিমের বাসিন্দা৷ এখন তিনি গুরুগ্রামের সেক্টর ১৭-য় থাকেন৷ রবিবার ভোররাতে মধ্য দিল্লির কন্নট প্লেস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন৷ পুলিশ জানিয়েছে, ওই তরুণী যখন প্রায় বাড়ির কাছাকাছি, ঠিক সেই সময় তাঁর উপর চড়াও হয় দুষ্কৃতীরা৷ তাঁকে অপহরণ করে একটি ছোট গাড়িতে জোর করে তুলে নেওয়া হয়৷ এরপর গুরুগ্রাম থেকে পশ্চিম দিল্লির নজফগড়ের দিকে রওনা দেয় গাড়িটি৷ চলন্ত গাড়িতেই তরুণীকে ধর্ষণ করে তারা৷ এরপর গুরুগ্রাম থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নজফগড়ের রাস্তায় দুষ্কৃতীরা তরুণীকে গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পালায়৷ রোহতাকে গণধর্ষণের ঘটনার দু'দিন পরের এই ঘটনা আরও একবার রাজধানীর নারী সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে৷
স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে কোনও রকমে স্থানীয় থানায় পৌঁছান নির্যাতিতা৷ সেখান থেকে গুরুগ্রাম পুলিশের কাছে খবর পৌঁছায়৷ নির্যাতিতার বয়ান রেকর্ড করেছে পুলিশ৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে জানাতে পারেন নীচে মন্তব্যের ঘরে...