নির্বাচনি প্রচারণায় বিরোধীরা সমান সুযোগ পাবে কবে?
২৩ ডিসেম্বর ২০১৮বাংলাদেশে নির্বাচনি সহিংসতা আর বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের খবরে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ৷ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টেফানে ডুজারিক বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে নির্বাচনি সহিংসতা এবং বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের খবরে জাতিসংঘ বেশ উদ্বিগ্ন৷’’
নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং-এ ডুজারিক বলেন, ‘‘অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের ব্যাপারটি নিশ্চিত করার জন্য আমরা এর স্টেক হোল্ডারদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি৷ নিরাপত্তা বাহিনীর কাজ হলো সব প্রার্থীর জন্য অবাধ ও নিরঙ্কুশ প্রচারণা নিশ্চিত করা৷’’
এর আগে জাতিসংঘের আটজন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এক যৌথ বিবৃতিতেও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেন৷ তাঁরা বলেন, ‘‘বিরোধী রাজনীতিক ও ভিন্নমত প্রকাশকারীরা নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর হাতে গ্রেপ্তার ও ভীতি’র সম্মুখীন হচ্ছেন৷ বিরোধী দলগুলোর সদস্য ও সমর্থকেরা গ্রেপ্তার, হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছেন৷ কোনো কোনো ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা জড়িত৷’’
এছাড়া, গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) দাবি করেছে, ‘‘বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে বিরোধী নেতাকর্মীরা হামলা ও হুমকির মুখে পড়ছেন৷’’
এইচআরডাব্লিউ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস দাবি করেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীন ও বিরোধী কণ্ঠকে দমন করছে৷ পূর্ণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পথে যাতে কেউ বাধা না হয় - এটাই তাদের উদ্দেশ্য৷ সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ দলের সমর্থক ও নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার, খুন ও গুমের শিকার হচ্ছেন৷ এর ফলে এমন এক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিপন্থি৷’’
বিএনপির বরাত দিয়ে এইচআরডাব্লিউ লিখেছে, ‘‘সেপ্টেম্বর থেকে এপর্যন্ত বিএনপি’র তিন লাখের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে৷ এসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷ এইসব মামলায় কয়েক হাজার বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে৷’’
এদিকে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়নে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র৷ রবিবার সংবাদমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘‘শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জাতীয় দায়িত্ব পালনরত নির্বাচন কমিশন জনগণের প্রত্যাশা পূরণে এবং সব দলের প্রার্থীদের জন্য সমান সুযোগ তৈরিতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না৷ এছাড়া গত কয়েকদিনে দেশের কয়েকটি জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা ও আগুনের ঘটনা ঘটেছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক৷ এর পাশাপাশি প্রতিমা ভাংচুরের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে৷’’
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্নস্থানে সহিংসতার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে৷ বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের বা জোটের প্রার্থীদের ওপর আক্রমণ, তাদের নির্বাচনি প্রচারণায় বাধা দেওয়া এবং নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে৷ পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিভিন্ন প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতার, নানাভাবে হয়রানি ও আইনি জটিলতায় ফেলছেন বলে অভিযোগ উঠেছে৷ ফলে অনেক এলাকাতেই প্রার্থীরা ঠিকভাবে নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে পারছেন না৷’’
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ‘‘গত ১১ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৩৪টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷ এসব ঘটনায় আটজন নিহত ও ২ হাজার ১৫২ জন আহত হয়েছে৷ এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের মধ্যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা আশংকা ও ভীতি কাজ করছে৷’’
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে নির্বাচনি প্রচারণার যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ও ১৪ দল নির্বাচনি প্রচারণার সুযোগ পাচ্ছে পুরো মাত্রায়৷ অন্যদিকে, বিরোধীরা বা বিএনপি’র প্রাধান্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তেমন সুযোগ পাচ্ছে না৷ তারা হামলা ও ভীতির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷ এমনকি তারা অধিকাংশ জায়গায় নির্বাচনি পোস্টারও লাগাতে পারছেন না বলে অভিযোগ৷
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেতে তাঁর সরেজমিন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘‘আমি গত কয়েকদিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কয়েকটি নির্বাচনি এলাকা ঘুরেছি৷ তাতে দেখেছি, এখন গায়েবি মামলায় বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে৷ হামলা হচ্ছে৷ বিরোধীরা প্রচার প্রচারণায় তেমন নামতে পারছেনা৷ আওয়ামী লীগের দু’জন নির্বাচনি সহিংসতায় নিহত হয়েছেন৷ আমার মনে হয়েছে নির্বাচনের আগে যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন না বা ভোটকেন্দ্রে যাবেন না৷’’
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমান সুযোগ বলতে আমরা যা বুঝি তা পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছি না৷ বাংলাদেশে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচন দেখেছি৷ সেখানে সব দল যেভাবে সমান সুযোগ পেয়েছে, এবারের নির্বাচন তার থেকে অনেক দূরে রয়েছে৷ নির্বাচন কমিশন তার ভূমিকা ঠিকমত পালন করছে না৷’’
তবে, আওয়ামী লীগরে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম রবিবার এক সংবাদ সম্মলেনে দাবি করেন, ‘‘নির্বাচনের আগে নীলনকশা অনুযায়ী বিএনপি-জামায়াত-ঐক্যফ্রন্ট জোট সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে৷ তারা গণতান্ত্রিক রীতিনীত অনুযায়ী নির্বাচনের মাঠে না থেকে দেশের সবখানে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও হামলা পরিচালনা করছে৷ আওয়ামী লীগ এবং অন্য সব গণতান্ত্রিক দল ও জোটের অফিস ভাঙচুর, মিছিলে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করছে৷ এসব করে তারাই আবার তাদের ওপর হামলার অপপ্রচার চালাচ্ছে৷’’ তিনি নির্বাচন কমিশনকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান৷