আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার দুই মাস পেরিয়েছে। এই সময়কালে বাজারদর সহনীয় পর্যায়ে আসেনি বা নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। জনমনের প্রত্যাশার বিপরীতে পরিস্থিতি এখনো বেশ অসহনীয়। ফলে, জনমনে এমন ধারণাও দানা বাঁধছে যে জিনিসপত্রের দাম কমানোর বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছে না বা দিলেও সফল হতে পারছে না। বিষয়টা কি আসলেই সেরকম? এই নিবন্ধে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে।
প্রথমেই যে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে, তা হলো, বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম অনেকদিন ধরেই চড়া হয়ে আছে। মাঝে-মধ্যে কোনো কোনো পণ্যের দর কিছুটা কমলেও পরে আবার তা আগের স্তরে ফিরে আসছে। আর কোনো কোনো পণ্যের দাম আগের তুলনায় বেড়েছে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-র পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি বছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সরু চালের দাম কেজি প্রতি মানভেদে ৬৪ টাকা থেকে ৮০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। এক বছর আগে একই সময়ে যা ৬০ টাকা থেকে ৭২ টাকার মধ্যে ছিল। মানে গড়ে এক বছরে চালের দাম প্রায় ৯ শতাংশ হারে বেড়েছে। আবার একই সময়কালে আটা, ভোজ্য তেল ও চিনির দর গড়ে প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে কিন্তু সবজির দাম বেশ বেড়েছে বলে টিসিবির পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়। পাশাপাশি পেয়াঁজ-রসুনসহ বেশিরভাগ মশলাপাতির দাম বেড়েছে।
সম্প্রতিকালে বাজারদর চড়া থাকার একটি বড় কারণ হলো জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের উত্তাল সময়টায় দেশের সরবরাহ প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়া। আবার আন্দোলনে শেষে অন্তর্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই দেশের পূর্বাঞ্চলে প্রবল বন্যা শুধু সরবরাহকেই বাধাগ্রস্ত করেনি, কিছু পণ্যের উৎপাদন সাময়িকভাবে থামিয়ে দিয়েছে কৃষি কাজ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো বাধাগ্রস্ত হওয়ায়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) প্রাক্কলন হলো, এই বন্যায় প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যা চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের পৌণে দুই শতাংশ।
বিশ্ববাজারের পরিস্থিতিও অনকূলে নেই। বিশ্বব্যাংক অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে যে বৈশ্বিক ভোগ্যপণ্য মূল্যসূচক প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় যে সেপ্টেম্বর মাসে জ্বালানির মূল্য ৭ শতাংশ কমলেও খাদ্য এবং কাঁচামালের দর উভয়ই তিন শতাংশ হারে বেড়েছে। আবার টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দরপতন হয়ে চলায় আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে টাকার দর কমেছে ৮ শতাংশের কিছু বেশি হারে।
উচ্চমূল্য পরিস্থিতির বিষয়টি জাতীয় মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানের প্রতিফলিত হয়েছে বহুলাংশে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উপাত্ত অনুসারে, জুন মাসে যেখানে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, সেখানে তা জুলাই মাসে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উন্নীত হয়। অবশ্য আগস্ট মাসে তা খানিকটা কমে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ হয় যা সেপ্টেম্বরে আরেকটু নেমে এসে হয় ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তার মানে, মাসওয়ারী মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করছে, তবে তা এখনো উচু পরযায়েই রয়েছে। কেননা, বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার গত বছরের সেপ্টম্বরে ৯ দশমিক ২৯ শতাংশ থাকলেও এ বছরের সেপ্টেম্বরে হয়েছে ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য মূল্যস্ফীতির হারকে নামিয়ে আনার জন্য নীতি সুদের হার বাড়ানোর পথে হাঁটছে। পরিবর্তিত পটভূমিতে নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর গত দুই মাসে দুই দফা নীতি সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে যেন মানুষের হাত থেকে টাকা কিছু ব্যাংকে গিয়ে জমা হয়। তাতে করে বাজার টাকার সরবরাহ কমবে, সামগ্রিক চাহিদাও কিছুটা কমবে। ফলে, মূল্যস্ফীতিও নিম্নমুখী হবে। এই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সুফল মিলতে অবশ্য কিছুটা সময় লাগবে। যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, তাহলে বছর শেষে কিছুটা অগ্রগতি হবে।
নিত্যপণ্যের বাজারদরের চাহিদাকে অর্থনীতির পরিভাষায় বলা হয় অস্থিতিস্থাপক। অর্থাৎ, দাম বাড়লে চাহিদা কমে – এই সূত্রটি এখানে পুরোপুরি খাটে না। দাম বাড়লেও মানুষ চাল-ডাল বা তেল-নুন কেনা অনেকটা কমিয়ে দেয়, এমন হয় না। কারণ, এগুলো অত্যাবশ্যকীয়। মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ বরং গুণগতভাবে নিম্নমানের পণ্য সামান্য কম দাম দিয়ে সংগ্রহ করে তাদের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে। আবার অনেক পণ্যের ভোগ কিছুটা কমিয়ে দেয়। এতে করে মোট জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশ খাদ্যমান ও পুষ্টির সাথে আপোষ করতে বাধ্য হয়, যা বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই হচ্ছে।
আবার মুষ্টিমেয় কিছু বড় উৎপাদক ও আমদানিকারকের কাছে কাছে বাজারের বেশিরভাগ পণ্যের যোগান বা সরবরাহ নির্ভরশীল। এরা কখনো কখনো প্রতিযোগিতাশীলতাকে উপেক্ষা করে বা পারস্পরিক যোগসাজশে পণ্যের সরবরাবহ নিয়ন্ত্রণ করে যার নেতিবাচক প্রভাব প্রথমে পাইকারী বাজারে পণ্যের দামে, তারপরে খুচরা বাজারে গিয়ে পড়ে বলে। তবে, ঢালাওভাবে যে বাজার সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়, বাস্তবে সেরকম কোনো গোষ্ঠী বা চক্রের উপস্থিতি ততোটা দৃশ্যমান নয়।
তাছাড়া এই সরবরাহ শেকলের প্রতিটি ধাপে চাঁদাবাজির কারণে পণ্য পরিবহন ও স্থানান্তরে খরচ বাড়ে। দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা চাঁদাবাজির শক্তিশালী চক্র সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে রাতারাতি হাওয়া হয়ে যায়নি। আওয়ামী লীগের মদদপুষ্ট চাঁদাবাজরা অনেকেই আত্মগোপনে গেলেও তাদের শূন্যস্থান পূরণে দ্রুতই বিএনপিপন্থী চাঁদাবাজরা তৎপর হয়ে উঠেছে। আবার অনেকক্ষেত্রেই বিএনপিপন্থী নব্য চাঁদাবাজদের সহযোগিতা দিয়ে আড়াল থেকে টিকে আওয়ামীপন্থী চাঁদাবাজদের একাংশ।
বস্তুত বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের সময়ে অনুপার্জিত আয় (রেন্ট সিকিং) এবং স্বজনতোষী পুঁজিবাদকে (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) ব্যাপকভাবে মদদ দিয়ে উৎসাহিত করা হয়েছিল। যার ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্বিভাব ঘটে রেন্ট সিকার বা অনুপার্জিত আয়কারীদের । এদেরকে পরজীবী শ্রেণী বা লুটেরা শ্রেণীও বলা যায়। কেননা, এরা নিজেরা কাজ করে কোনো আয় করে না, বরং অন্যের আয়ে ভাগ অন্যায়ভাবে ভাগ বসায় বা তা থেকে লুট করে। এই অপকর্মের বৈধতা দেয়ার জন্য কিছু কৃত্রিম সেবাদান করে থাকে। যেমন, পাইকারী বাজারে পণ্যবাহী ট্রাক ঢুকলে তার নিরাপত্তা দেয়ার নাম করে চাঁদা তোলা। এভাবে এই অনুপার্জিত আয়কারী চক্র নিত্যপণ্যের বাজারদর বাড়িয়ে তোলে।
অন্যদিকে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বলতে বোঝায় রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষ মহলের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বড় বড় ব্যবসা ও প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেওয়া। একটি বড় ব্যবসা বা প্রকল্পের কাজ পেতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে, এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কাজ দেওয়া হয়। সে কারণে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা অনৈতিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়েন। এতে করে এসব সরকারের স্বজন বা ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত হওয়া ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ফুলে ফেঁপে ওঠেন আর তাদের হাতে আটকে যায় অনেক বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশে এস আলম শিল্পগোষ্ঠী এরকম একটি উদাহরণ যাদের হাতে পণ্য আমদানির এক উল্লেখযোগ্য অংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল। ফলে, তারা বাড়তি মুনাফার জন্য সহজেই পণ্য বাজারকে ব্যবহার করতে সক্ষম ছিল। ক্ষমতার পালা বদলের পর এই গোষ্ঠী নজরদারির আওতায় আসায় আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। এটা সাময়িকভাবে বাজারে কিছুটা সরবরাহ সংকট তৈরি করেছে।
অনুপার্জিত আয়কারীদের চক্র ও স্বজনতোষী বণিকগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমনভাবে গেঁড়ে বসেছে যে বাজারের চাহিদা-সরবরাহে এদের সম্পৃক্ততা বেশ নিবিড়। খুব সহজে এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া কঠিন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার একদিকে মুদ্রানীতির মাধ্যমে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে চাইছে। অন্যদিকে রাজস্বনীতির আওতায় আমদানি শুল্কহার কমিয়ে আলু, পেঁয়াজ ও চিনির আমদানি ব্যয় কমানোর চেষ্টা চলছে। ডিম আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। হয়তো এই আমদানির শুল্কও কমবে। পাশাপাশি প্রশাসনিক পদক্ষেপ হিসেব বাজার তদারকীর কাজও শুরু হয়েছে। এসব কিছুর সমন্বিত সুফল পেতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে বলে ধরে নেয়া যায়।
তবে মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধের দামামা বাজছে, তা ইতিমধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার সুয়েজ খাল ও হরমুজ প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচলের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বিমা ব্যয়ও বেড়ে গেছে। সামনে তা আরো বাড়তে পারে। এতে করে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি ব্যয় বাড়বে যা বাজারদরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। সুতরাং, সহসা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলার সুযোগ কমে গেছে।