নিজেরা বানিয়ে টিকার সংকট কাটাতে চায় আফ্রিকা
৫ জুলাই ২০২১গোটা আফ্রিকার গায়ে লেগেছে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা যা আগেরগুলোর চেয়েও মারাত্মক হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ বিশেষ করে ভারতকে বিপদে ফেলা ডেল্টা ধরন মহাদেশটিতে দ্রুত ছড়াতে শুরু করেছে৷ এর মধ্যে বিপদের বিষয় হল সেখানকার জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ এখন পর্যন্ত করোনার টিকা নিতে পেরেছেন, আড়াই শতাংশ পেয়েছেন প্রথম ডোজ৷ অথচ ইউরোপের অর্ধেক মানুষই এর মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন৷ প্রতি তিনজনের একজন দুই ডোজই পেয়েছেন৷
আফ্রিকার ঘুরে দাঁড়ানোর সময়
টিকা না পাওয়ায় আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের নেতারাই উন্নত দেশগুলোর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন৷ গত সপ্তাহে কাম্পালাতে আয়োজিত বিশ্ব স্বাস্খ্য সম্মেলনে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট উওয়েরি মুসেভেনি বিষয়টিকে স্বার্থপরতা হিসেবে অভিহিত করেছেন৷ তবে আফ্রিকার দেশগুলোর নিজেদেরই এর সমাধান বের করার আহ্বান জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘এটা লজ্জাজনক যে আফ্রিকা মহাদেশ ঘুমাচ্ছে এবং অন্য কেউ এসে উদ্ধার করবে সেই আশায় অপেক্ষা করছে৷’’
শুধু করোনা নয় যেকোন রোগের টিকার জন্যই আফ্রিকাকে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ বা এশিয়ার দেশগুলোর উপর নির্ভর করতে হয়৷ যত টিকা প্রয়োজন হয় তাদের তার মাত্র এক শতাংশ নিজেরা উৎপাদন করতে পারে৷ বর্তমানে টিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও সেনেগালে রয়েছে টিকার কারখানা৷
অবশ্য এই পরিস্থিতির বদল ঘটার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে৷ বেশ কয়েকটি দেশ কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিয়েছে৷ ২০৪০ সালের মধ্যে টিকার চাহিদার ৬০ শতাংশ অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আফ্রিকা ইউনিয়ন৷ তবে এই পরিকল্পনার পথে আফ্রিকাকে বেশ কিছু বাধা অতিক্রম করতে হবে৷
সামনে বাধা
টিকা উৎপাদনের জন্য বিশেষ প্রযুক্তিগত কাঠামোই শুধু প্রয়োজন নয় সঙ্গে দক্ষ কর্মী ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও চাই৷ আর সবকিছুর জন্য লাগবে বিপুল বিনিয়োগ৷ এমনকি শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলোও বিশাল আকারের এই বিনিয়োগ একা করে না৷ এক্ষেত্রে সরকার এগিয়ে আসে যা আফ্রিকার অনেক দেশের পক্ষে সম্ভব নয়৷ যে কারণে সেনেগাল, টিউনিশিয়া ও আলজেরিয়ার মতো হাতে গোনা কয়েকটি দেশ উন্নয়ন অংশীদারদের সহযোগিতায় উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছে৷ অন্যদিকে বিনিয়োগের অভাবে বছরের পর বছর চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলো৷
তবে মহামারির ধাক্কায় একটি পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয়েছে৷ বিভিন্ন দেশ মিলে বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালুর অপেক্ষায় রয়েছে৷ এক্ষেত্রে ইইউ, বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে এসেছে৷ গত মে মাসে সাউথ আফ্রিকা সফরে গিয়ে জার্মান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়ান্স স্পানও প্রায় ছয় কোটি ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়ে আসেন৷
উদ্যোগগুলো যেভাবে এগুচ্ছে
প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে প্রথমেই আঞ্চলিক বাজারের জন্য টিকা উৎপাদনে মূল প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে৷ এরপর বসাতে হবে কারখানা৷ আনতে হবে টিকা উৎপাদনের কাঁচামাল৷
এরিমধ্যে এই ধাপগুলো পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা উৎপাদন করছে সাউথ আফ্রিকা৷ মিশরের একটি কোম্পানি চীনের সিনোভ্যাক এর টিকা উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে৷ সেনেগাল ও আলজেরিয়াতেও কয়েকটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সঙ্গে আন্তর্জাতিক টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়েছে৷
কিন্তু নতুন করে যারা টিকা উৎপাদনে যেতে চায় তাদের জন্য কাজটি ততটা সহজ হবে না৷ আফ্রিকান ভ্যাকসিন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যালায়েন্স এর পরিচালক সাইমন আগওয়ালের মতে গোটা একটি উৎপাদন ইউনিট তৈরি করতে প্রায় ১৮ মাস সময় লাগে৷ তার উপর করোনা কারণে এই ধরনের যন্ত্রপাতিগুলোরও চাহিদা বেড়ে গেছে, সেগুলো সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎপাদনকারীদের কাছেও অপেক্ষার লম্বা লাইন পড়েছে৷ আবার বিপুল বিনিয়োগ ও জটিলতাগুলো পেরিয়ে করোনা টিকা উৎপাদনের জন্য কারখানাগুলো প্রস্তুত হলেও মহামারির পর সেগুলোর কী হবে সেটিও একটি বড় প্রশ্ন বলে মনে করেন তিনি৷
নিজেদের উৎপাদনের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হলেও সেটি কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷ কেননা কাঁচামালের জন্য শেষ পর্যন্ত উন্নত দেশগুলোর মূল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উপরই কিন্তু নির্ভর করতে হবে৷
ইয়ান ফিলিপ ভিলহেল্ম/এফএস